ধর্ষণের শেষ কোথায় ?

মামুন আকন
মামুন আকন, ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১০:১২ পিএম, ১১ মে ২০১৯ | আপডেট: ০৪:০২ পিএম, ১২ মে ২০১৯

ধর্ষণের শেষ কোথায়

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খোলার আগে মনে মনে প্রার্থনা করি অন্তত আজ কোনো প্রকার ধর্ষণের খবর যেনো চোখে না পরে। কিন্তু প্রতিদিন পত্রিকার পাতাজুড়ে বিচার না পাওয়া অসহায় তনুদের আর্তনাত হেডলাইন হয়ে আসে। কারণ তনুরা আজও বিচার পায়নি!

যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করা নুসরাত’রা সিরাজুদ্দৌলার দেয়া আগুন থেকে বাঁচার আকুতি করতে করতে হাসপাতালের বেডে নির্মম মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে।

রমজান মাসে মা-বাবার সাথে কিছুদিন কাটাবে বলে সারাদিন রাত হাসপাতালে সেবা করা নার্স তানিয়া’রা আর ঘরে ফিরতে পারে না,কারণ পথিমধ্যে ৪/৫ জন হায়না যে তানিয়াকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে!!

কতটা অসহায় আমাদের সমাজের মেয়েরা!
আমাদের দেশের অর্ধ জনশক্তি যেখানে নারী, যাদের কাজের বিনিময় আজ বাংলাদেশটা একটু একটু করে বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়াচ্ছে সেই দেশের মেয়েরা আজ ঘর থেকে বের হলে

আসংখ্যায় থাকে “ঘরে ফিরতে পারবো তো”!! কতটা ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে মানুষ রূপি কিছু নরপশুরা।

“মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ” দেশের ৬ টি পত্রিকায় আসা নিউজের উপর ভিত্তি করে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখিয়েছে চলতি মে মাসের প্রথম ৮ দিনে ৪১ জন শিশু ধর্ষণ হয়েছে যার মধ্যে ৩৭ জন নারী শিশু।

এতো ধরাও পাকড়াও তারপরেও যেনো মহামারীর আকার ধারণ করেছে ধর্ষণ । আপনি যদি মনে করেন পর্দা না কারার কারনে এসব হচ্ছে, তাহলে আমি বলবো আপনি অসুস্থ।

একটা ৫/৬ বছরের মেয়ে কতটা পর্দা করা উচিত? দুই বছরের শিশু বা ৬০ উর্ধো মহিলা আপনার মনে কিভাবে যৌনতার খায়েশ জাগায় আর যখন তারা ধর্ষিত হয় তখন আপনি কোন পর্দার দোহাই টানবেন?

সমস্যা যে আমাদের পশু ভিত্তিক মনের তা আমরা অনেকে ভেবেও দেখি না। এক্ষেত্রে বিখ্যাত নিউরোলোজিস্ট এবং পরবর্তীতে সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রয়েড এর একটি তত্ত্ব তুলে ধরছি, তিনি বলেছেন যাকে আমরা মন বলি সেটি মূলত তিনটি সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত – ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। অর্থাৎ মানব মন এই তিনটি গাঠনিক উপাদানে তৈরি - “ইড” মূলত মানুষের জৈবিক সত্ত্বা। মানব মনের স্বভাবজাত চাহিদা পূরণ করে ইড। এটিকে “মন যা চায় তাই” এর সাথে তুলনা করা যায়। “ইড” মানুষ এবং পশু সবার মাঝেই সমানভাবে বিরাজমান। এর কোন মানবিক দিক বা বিকাশ নেই। “ইড” এর পুরোটাই লোভ লালসা ও কাম চিন্তায় ভরপুর। “ইড” এমনভাবে মানুষকে প্ররোচিত করে যে, প্ররোচনায় মানুষ যে কোন অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে, খুন-ধর্ষণ পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। এক কথায়, “ইড” হচ্ছে আমাদের ভিতরের সুপ্ত পশু। সুপার ইগো হচ্ছে মানুষের বিবেক। ইড যখন জৈবিক কামনা বাসনা পুরণ করতে উদ্দীপ্ত করে, তখন সুপার ইগো একে বাধা দেয়। সুপার ইগো মানুষকে সব সময় মানবিক দুর্বলতার উর্ধে উঠে ভাল কাজ করার জন্য মানুষকে উদ্দিপ্ত করে। এই বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নির্ভর করে ব্যক্তির নৈতিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক শিক্ষা এবং মুল্যবোধের উপর। অন্যদিকে ইগো হচ্ছে এই দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী একটি অবস্থা। ইগো এবং সুপার ইগোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই এর কাজ। ইড বলবে – I need to get it. সুপার ইগো বলবে – You have no right to get it ইগো বলবে – I need some plan to get it. অর্থাৎ ইগো ইডের ইচ্ছাটা বাস্তবায়ন করবে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। পশুরা ইড চালিত। তাই তারা কেবল জৈবিক চাহিদা (খাবার এবং যৌনতা) পূরণেই ব্যস্ত। আবার মানুষের মধ্যে যখন “ইড” ডমিনেন্ট হয়ে যায়, তখন সে উন্মাদ ও অমানুষ হয়ে যায়। আর যখন কেবল সুপার ইগো কাজ করে – তখন সে সাধু সন্যাসী পবিত্র হয়ে যায়।ইগো এই দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। যেমন মানুষের মধ্যে যখন সুপার ইগো ডমিনেন্ট হয়, তখন অনেক সময় তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন চলে আসে। ইগো তখন ব্যালেন্স করে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা সুপার ইগোকে মানতে গিয়ে আমরা আমাদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে পারি না। আমাদের এই অপূরণীয় চাহিদায় মন তখন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তখন বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে ইগো কাজ করে। জীব হিসেবে মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর তেমন বেশি ডিফারেন্স নেই। উভয়েরই ইড আছে। কিন্তু মানুষের এর সাথে দুইটা জিনিস আছে ইগো এবং সুপার ইগো।

কিন্তু যখন শুধু মাত্র মানুষের মধ্যে ইড চালু থাকে তখন তার ভিতরে সমস্ত ভয় ভিতি পালিয়ে যায়,সে সুধু তার চাহিদা কেই বড় করে দেখে। এক কথায় হিংস্র পশু আর তার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।

যেমনটা তানিয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা খুনিদের মধ্যে কোনো অনুতপ্তের ছাপ দেখা যায়নি৷ দেখা যায়নি সিরাজুদ্দৌলার চেহারাতেও,আদালত চত্তরে কি মিষ্টি মুখের হাসি। আবার এমনো দেখা গেছে একজনে ধর্ষণ করে কিছুদিন পরে জামিনে বের হয়ে দলবল নিয়ে অভিযোগ কারীকে গনধর্ষন করেছে!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ষণ কেন হচ্ছে? কেনইবা ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকেই দিচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। কেউ মনে করেন ধর্ষণের সাথে পরোক্ষভাবে নারীদের পোশাক জড়িত, কেউ মাদক-পর্নোগ্রাফি বা বিজাতীয় অপসংস্কৃতিকে দায়ী করেন ধর্ষণের কারণ হিসাবে। ধর্ষণের পেছনের অদৃশ্যমান আরেকটি কারণ কিছুটা হলেও উন্মোচন করেছে নারীপক্ষ নামক একটি সংস্থা তাদের গবেষণার মাধ্যমে। নারীপক্ষ তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে , ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র ৪ জনের সাজা হয়েছে। ধর্ষণ মামলায় হাজারে সাজা হচ্ছে মাত্র চার জনের। মহিলা আইনজীবী সমিতির আরেক জরিপে দেখা যায় ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এসব মামলার ভেতরে যেগুলোর রায় হচ্ছে সেখানেও আছে দীর্ঘসূত্রিতা , এই সুদীর্ঘ সময়ে ধর্ষিতাকেও মনস্তাত্ত্বিক ধর্ষণের শিকার হতে হয় বছরের পর বছর জুড়ে।

ধর্ষিতারা লোকলজ্জার ভয়ে নির্যাতনকে গোপন করছেন, ধর্ষকেরাও পার পেয়ে যায় নানা ফন্দি-ফিকিরে এই সংস্কৃতিই হয়তো ধর্ষকামীদের ধর্ষণ করার সাহস যোগায়।

কিন্তু কতকাল এভাবে চলতে থাকবে? ১০ বছর আগে যখন এসিড মারার প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছিলো তখন মৃত্যু দন্ডের বিধান রেখে আইন করা হয়েছিলো এবং তা ৩০ দিনের মধ্যে কার্যকর করা হবে বলে সরকারি ভাবে টিভিতে, রেডিওতে, পোষ্টার ছাপিয়ে প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় পৌছে দেওয়া হয়েছিলো। আজ এসিড নিক্ষেপ সমাজে নেই বললেই চলে।

একজন ধর্ষক যখন নিজ মুখে স্বীকারোক্তি দেয় তিনি সে অন্যায় করেছে কিংবা ধর্ষণের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা আছে তাহলে কেনো বিচার ব্যবস্থার এই লেন্দি প্রসেস? এটাকি অপরাধীদের আরো অপরাধ করতে দেওয়ার সামীল নয়??

কিছুদিন আগে হারকিউলিস নামে কিছু ধর্ষণ মামলার আসামীদের গুলি করে ফেলে রেখে যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিলো,দেশের মানুষ এটাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ বলে তাদের ব্যাপক প্রশংসা করেছে। সত্যিকার অর্থে মানুষ চায় এই জঘন্য কাজ যারা করে তাদের এরকমই শাস্তি হোক। আমাদের দেশের সরকারের ও উচিত ১০ বছর আগের এসিড নিক্ষেপ যেভাবে বন্ধ করেছিলো সেভাবে ধর্ষণকারীদের জন্য সর্বচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে জনসম্মুখে ফায়ার করে মেরে ফেলার বিধান করা। মাত্র দুইটা ধর্ষণ মামলার বিচার এভাবে জনসম্মুখে গুলি করে মৃত্যু দন্ড দিয়ে দেখেন এদেশের ধর্ষণ আগামী এক মাসের মধ্যে শূন্যতে নেমে আসবে। তেমনি সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও কিছু কাজ করতে হবে,যারা ধর্ষণ করে বা করছে তারা আপনার আমার এলাকারই মানুষ। এদের সাথে আমরা সকল প্রকার সমাজিক, আর্থিক, পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের এলাকা থেকে বিতারিত করে দিতে পারি। এথেকেও তাদের মনে ভয় জন্মাবে, অপরাধ করার আগে শতবার ভাববে। আর যদি এটা বন্ধ করা না যায় মনে রাখবেন আগামীতে আমাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। যার জন্য দায়ী আপনি আমিই!!

লেখকঃ- মামুন আকন

ফিচার লেখক,পাথরঘাটা নিউজ
মেইলঃ mamunakon94@gmai.com

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)