মাছের উৎসবে কোচের হানা

রুদ্র রুহান
রুদ্র রুহান, জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০২:২১ এএম, ৯ জুন ২০১৯

মাছ ধরার যন্ত্র, কালমেঘা, মাছ, অন্ধকার
রাত ন’টা নাগাদ ঘোর অন্ধকারে হঠাৎ এমন একদল মানুষের আগমনের পদশব্দ। কর্দমাক্ত পথে দূর থেকে আচমকা মনে হবে কোনো ডাকাতদল
সংঘবদ্ধভাবে আক্রমনের প্রস্ততি নিচ্ছে কোথাও। কিছুটা ভীতির সঞ্চার হলেও ঘোর কাটে কাছে আসতে। বাম হাতে টর্চ ডান হাতে কোচ (মাছ ধরার যন্ত্র)। কোমরে ঝোলানো চটের ব্যাগ হাতে একদল লোক। জৈষ্ঠের শেষে আষাঢ়ের আগমনী বার্তায় মুখর প্রকৃতি।কোলা ব্যাঙেরা
যেন গর্তে থেকে এমন প্রহরের অপেক্ষায় ছিল। মাঠের পানিতে তাদের দাপাদাপি ও টানা ডাক শুনে কুনো ব্যাঙেরাও ঘরের কোণ ছেড়ে পথে নেমেছে।

প্রকৃতিতে যখন এমন “জলবরণ” প্রস্ততি তখন মাছেরাও যোগ দেয় সে উৎসবে। জোয়ারে “গাঙ” থেকে জলে গা ভাসিয়ে নালা বেয়ে সাগরের মত
ফসলের মাঠে ভুলক্রমে ঢুকে পড়ে। অল্প পানির মাছ, দাপাদাপিতে অস্থির। কোচ শিকারীরা ঠিকই খোঁজ রাখেন। দলবেঁধে মাঠে নামেন, টর্চের আলোয় চলে মাছের সন্ধান। গোটা ফসলের মাঠ দূর থেকে দেখে মনে হয় সাগরে জেগে ওঠা কোন চরে গড়ে উঠেছে নতুন এক সভ্যতা।

বরগুনার পাথরঘাটার কালমেঘা গ্রামের সর্দার বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেরই ঘরে সারা বছর অবসর যাপন করে একখানা কোচ। সর্দার বাড়ির আফজাল সর্দার ঝানু শিকারিদের একজন। শিকারে তার এ অঞ্চলে বিশেষ সুখ্যাতি আছে। প্রতিবছরই সবার আগে সবচেয়ে বড় বোয়াল মাছটা ঘরে তোলেন আফজাল। শিকারের পদ্ধতি জানালেন আফজাল। নিজেদের মুনশিয়ানায় বাঁশের ডগার আড়াই থেকে তিন হাতের অগ্রভাগে সাইকেলে পুরনো স্পোকের এক দিক সুচালো করে ১২/১৫ টি স্পোক চিকন রশিতে বেঁধে তৈরি করা হয় কোচ।

সন্ধ্যার পরপরই দল বেঁধে ফসলের মাঠে জমা পানিতে টর্চের আলোতে দেখা মিললে মুহূর্তেই শক্ত হাতের নির্ভুল নিশানায় কোচে গেঁথে ফেলে শিকার করা হয় মাছ। আফজাল বলেন, “এ সিজনটায় দল বেঁধে মাছ শিকার ভিন্ন এক আমেজ। নতুন পানিতে আসা বোয়াল মাছ শিকারই তাদের প্রধান লক্ষ। তবে গুলিশা প্রজাতির টেংরা মাছও ধরা পরে।’ আফজালের হতাশার স্বরে বলেন, ‘এহন আর আগের মত জিয়াল মাছ পাওন যায়না’। তিনি বলেন, ‘আগে নতুন পানিতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ত।

কিন্তু বর্তমানে জিয়াল মাছের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। দেশীয় প্রজাতির কিছু মাছ বিলুপ্ত প্রায়।’

আফজাল মনে করেন, জলাশয় ভরাট হওয়ায় মাছের নিরাপদ বিচরণস্থল কমে আসছে। ফলে বংশ বিস্তার কম হয়। এছাড়াও নদ-নদীতে বিভিন্ন প্রকার জালে প্রচুর পোনামাছ ধরা পড়ে। ফলে দিনদিন জিয়াল মাছের সংখ্যা কমে আসছে। এমন মৌসুমে ১৫ বছর আগে প্রায় প্রতিদিন দু’চারটা বোয়াল শিকার করতেন তিনি। কিন্তু এখন প্রায়ই খালি হাতে ফিরতে হয়। এ বছর এখনো বোয়াল শিকার করতে পারেনে কেউ। তবু নতুন পানি মাঠে এলেই হাত নিশপিশ করে আফজালের। মরিচা ধরা
কোচে শান দেয় সে, চার্জ দিয়ে টর্চ রেডি করে রাখেন। আর সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় দল বেঁধে মাছ শিকারাভিযান। মাছ মিলুক অথবা না মিলুক, নতুন পানিতে মাছ-ব্যাঙদের এমন উৎসবের হানা দেয়া আফজালরা ঠিকই মেতে ওঠেন ভিন্ন এক উৎসবে।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)