সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়! (ভিডিও সহ)

Shafiqul
Shafiqul, এসআই খোকন
প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ২৯ জুন ২০১৯

ছবিঃ সংগ্রহীতদুই পাশে দু’জন। হাতে তাদের লম্বা রামদা। মাঝে ফেলে একজনকে তারা কোপাচ্ছে ইচ্ছামতো। এক নারী দৌড়ে এসে ঘাতকদের ঠেকাচ্ছেন; কিন্তু পারছেন না। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যাচ্ছে তারা।

প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার ওপর যখন এমন পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে, তখন চারপাশ ঘিরে আছে আরও বেশ কয়েকজন যুবক। পথচারীরাও দেখে দৌড়ে পালাচ্ছিল। প্রশ্ন হতে পারে, এটি কি সিনেমার কোনো চিত্র? না, এটি কোনো সিনেমা নয়।

এ ঘটনা বরগুনার প্রাণকেন্দ্রের কলেজপাড়া এলাকার। আর এ পুরো ঘটনাটি ভিডিও হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। যাদের চোখের সামনে এ ভিডিও পড়েছে, তারাই দেখেছে, দেখে আঁতকে উঠেছে। মানুষ ভয়ে কাঁপছিল ভিডিওটি দেখে।

আমি যখন ভিডিওটি দেখেছি, আঁতকে উঠেছি, এও কি সম্ভব? সারা দেশ এ ঘটনায় মর্মাহত, সবার সামনে একজনকে এভাবে কুপিয়ে মারা হল। তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ এগিয়ে এলো না। সমাজটা যাচ্ছে কোথায়? রক্তাক্ত সেই যুবকটিকে আর বাঁচানো যায়নি।

বুধবার বরগুনার এ ঘটনাটি দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও আলোচিত হয়। ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রবাসী বাঙালিরাও। খুনিদের বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠে দেশ। প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ডিশ ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ।

বরগুনায় বুধবার প্রকাশ্য দিবালোকে একদল পথচারীর সামনে যেভাবে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা, তা স্পষ্টতই সমাজের অধঃপতনের এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ রকম নৃশংস ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই।

রিফাত হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সারা দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার ঝড় বয়ে গেছে। নিন্দা আর প্রতিবাদে সরব হয়েছে সাধারণ মানুষ। রিফাত নামের ছেলেটি বাঁচতে চেয়েছিল। কী অপরাধ ছিল তার?

অপরাধ যাই হোক না কেন, তাকে প্রকাশ্যে এভাবে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা ঠিক হয়নি। কাকুতি-মিনতি করে ঘাতকদের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু ঘাতকদের মন তাতে একটুও গলেনি।

ধারালো রামদার আঘাতে রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কী নির্মম, কী করুণ এ মৃত্যু! আহা স্বাধীন দেশটাকে আজ স্বাধীন হিসেবে দাবি করাটাও লজ্জার। এ জন্য কি মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশটাকে স্বাধীন করেছিল? স্বাধীন করেছিল আমাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্য; কিন্তু দেখছি ঠিক তার উল্টোটা।

রিফাতকে প্রকাশ্য দিবালোকে যখন হত্যা করা হল, তখন আশপাশে অনেকেরই উপস্থিতি ছিল, অথচ তার স্ত্রী ছাড়া কেউই তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেনি। তারা যদি সম্মিলিতভাবে দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করত, তাহলে হয়তো বা রিফাতকে অকাল মৃত্যুবরণ করতে হতো না।

তাহলে কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নৈতিক মনোবল আমরা হারিয়ে ফেলছি? আমরা কি বর্বরতাকে রুখে দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলছি? কিছু দুর্বৃত্তের দাপটের কাছে আমরা কি জিম্মি হয়ে পড়েছি?

রিফাতের এ হত্যাকাণ্ড ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিশ্বজিৎকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। সেদিনও প্রকাশ্য দিবালোকে একদল মানুষের সামনে হত্যা করা হয়েছিল বিশ্বজিৎকে এবং সেই হত্যাকাণ্ডের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছিল।

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, রিফাত হত্যার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে উচ্চ আদালতও একই প্রশ্ন করেছেন। ওই ঘটনায় খুনিরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য পুলিশকে তৎপর থাকার পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।

যেদিন রিফাতকে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক সেদিনই গায়ে কেরোসিন ঢেলে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে দগ্ধ তরুণী ফুলন রানী বর্মণ মৃত্যুবরণ করেছেন। ওইদিনই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বিউটি আক্তার নামে এক আওয়ামী লীগ নেত্রীকে।

পরের দিন দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীণ চক্ষু হাসপাতালের সেবিকা তানজিনা আক্তার। সাম্প্রতিক সময়ে ফেনীর সোনাগাজীতে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার নির্দেশে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে।

সাম্প্রতিক সময়ে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রুহিতা গ্রামে স্ত্রী ও সৎমেয়েকে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যা করে সৎবাবা নিজেই আত্মহত্যা করেছে, আর স্ত্রী শানেজুর বেগম ৯ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন।

এরকম সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা আরও অনেক নৃশংস ঘটনার উল্লেখ করা যায়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে সমাজে কী ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে। কোনোভাবেই যেন এসব নৃশংসতাকে, এসব বর্বরতাকে থামানো যাচ্ছে না।

রিফাত হত্যার ঘটনার ভিডিও ও খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে আলোচনা ও নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তৎপর হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

এক কথায় সরকারের পক্ষ থেকে রিফাত হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সারা দেশ এ বিষয়টি নিয়ে তোলপাড়, প্রতিবাদে সোচ্চার।

সর্বস্তরের মানুষ এ নৃশংস হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। আর এ হত্যার বিচার দাবি করেছে পাথরঘাটা উপজেলা নাগরিক অধিকার ফোরাম, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আস্থা’, স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন প্রত্যয়, বরগুনার নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি, পাবলিক পলিসি ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন। সঙ্গে সঙ্গে এবার যোগ দিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম।

জানা যায়, এ পর্যন্ত অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। একইসঙ্গে এ প্রশ্নও উঠেছে, শুধু ভিডিও থাকলে বা ছবি থাকলেই কি এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে? লক্ষণীয় যে, যেসব নৃশংস ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসছে সেগুলোই সবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

এগুলো নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু তৎপরতাও দেখা যায়। কিন্তু অনেক ঘটনাই আছে যেগুলো তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত বা আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সব ধরনের নৃশংস অপরাধকে সমভাবে গুরুত্ব না দিলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

অবস্থাপন্ন পরিবারের কেউ যদি এ ধরনের নৃশংসতার শিকার হন, তখন তাদের ঘটনাই আলোচনায় থাকে। কিন্তু দেশে অসংখ্য প্রান্তিক মানুষ যে নিয়মিতই নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন, সে খবর অনেকেই রাখেন না।

সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি বলছে, আমরা যেন নৃশংস থেকে নৃশংসতর অভিজ্ঞতা অর্জনের দিকে যাত্রা করেছি। জাতি হিসেবে এ ঘটনাগুলো আমাদের জন্য উদ্বেগের। কোন পরিস্থিতিতে আমরা এমন পরিণতি বরণ করলাম তা ভাবতে হবে।

আইনের শাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য আশু তৎপরতা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় যথাযথ বিচার পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা, এমন অভিযোগও আছে।

শুধু বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডই নয়, আরও বহু হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রেও একই সত্য প্রতীয়মান হয়। প্রবাদ আছে, ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’; বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার দিকে তাকালে যেন এ সত্যই প্রতিভাত হয়; অথচ এমনটি কারও কাম্য হতে পারে না।

রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও একজন আইনজীবী বলেছেন, ‘এমন অপরাধের ঘটনার বিচার যদি কোনো কারণে বিলম্বিত হয়, তাহলে আরও এমন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।’

আমরা জানি, বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। ফলে প্রত্যাশা থাকবে, এমন জঘন্য ও মর্মস্পর্শী ঘটনার দ্রুত বিচার হোক। এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। দায়ীদের কঠোর সাজা হোক, যাতে সমাজে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

বিশ্বজিৎ আর রিফাত দিয়েই যেন শেষ হয়ে যায়। আমাদের জন্য যেন এমন ঘটনা আর অপেক্ষায় না থাকে।

শফিকুল ইসলাম খোকন : গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক
msi.khokonp@gmail.com

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)