বরগুনায় খুন হওয়া রিফাতই দোষী?

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ০২:৩৩ এএম, ৩০ জুন ২০১৯ | আপডেট: ০৩:২০ এএম, ৩০ জুন ২০১৯

রিফাত শরীফ
বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হলো রিফাতকে। কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন, খুনিদের একজনের সঙ্গে রিফাতের স্ত্রীর প্রেম ছিল। রিফাত তাকে বিয়ে করেছে বলেই তাকে খুন হতে হয়েছে। একজন যুবক প্রকাশ্যে খুন হলেন। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তরুণী বউটি স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

এই খুনের নৃশংসতার ব্যাপারটি এসব লোকদের চোখে পড়লো না, পড়লো প্রাক্তন প্রেম কাহিনী! বিকৃত মানসিকতা আর কাকে বলে। একজন খুন হলেন, দোষীদের শাস্তির বদলে খুঁজতে বসে গেলেন, যে খুন হলেন তার দোষ। তার কোন দোষে খুন হলেন, সেটাই প্রধান হয়ে উঠলো মনুষ্য আকৃতির সেই রামছাগলদের কাছে।

রিফাতের ক্ষেত্রে প্রাক্তন প্রেম বা পরকীয়া যদি খুনের কারণ হিসাবে জাস্টিফাই হয়। তাহলে সারাদেশে এমন খুনের বন্যা বয়ে যাবে। যারা জিকির তুলছেন প্রাক্তন প্রেমের ওজর-আপত্তিতে তারাই সম্ভবত প্রথম আক্রান্ত হবেন। কারণ তাদের চিন্তার পেছনে অভিজ্ঞতার নিশ্চিত একটি ব্যাপার রয়েছে। অদ্ভুত এক দেশে বাস করি আমরা। আপনাকে খুন করা হবে, তাও প্রকাশ্যে। সে বিচারের আগে আপনার বিচার বসবে, আপনার কী দোষ ছিল? খুনিরা কেন আপনাকে খুন করলো? আপনি খুনির প্রাক্তন প্রেমিকা কিংবা প্রেমপ্রার্থীকে বিয়ে করলেন কেন?

অবস্থা এমন যে, বিয়ে করার আগে আপনার এলাকায় মাইকিং, কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া উচিত ছিল, এই মেয়ের কোন প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমপ্রার্থী রয়েছেন কিনা। এমন চিন্তার রামছাগলদের দেশে বাস করি আমরা।

নিমতলী, চুড়িহাট্টায় মানুষ পোড়ে। দোষ হয় তাদেরই, কেন তারা কেমিক্যালের গোডাউন রাখলো। গাড়ির গতিসীমা মাপার যন্ত্র নেই রাস্তায়, গতিরোধক নেই, নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই, তবু দোষ গাড়ির গতির, দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের।

রেললাইনের বাঁশ, ৮০ টা বল্টুর মধ্যে থাকে ৩৫টা। তাও নড়বড়ে। স্লিপার নড়ে। এমন সেতু থেকে ট্রেন পড়ে যায়। মানুষের মৃত্যু হয়। ট্রেন বা সেতুর কিন্তু দোষ হয় না। দোষ হয় মানুষের, এত লোক কেন ট্রেনে উঠতে গেলো। মানুষের ভারেই ট্রেন পড়ে গেছে!
আমার ছেলেটা, সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুনকে হত্যা করা হয়েছে। রেললাইনের পাশে তার লাশ পাওয়া গেছে। কারো কারো বক্তব্য ট্রেন থেকে পড়ে গেছে। কেউ আগ বাড়িয়ে বলছেন, ছাদ থেকে পড়ে গেছে। অর্থাৎ তার দোষ খুঁজে বের করতে হবে, তার দোষেই তার মৃত্যু হয়েছে তা প্রমাণ করতে হবে।

ঘটনা পরিবেশ যাই বলুক না কেন, রেললাইনের পাশে পড়ে থাকাই তার দোষ। কেন সে পড়ে রইলো, কেন সে মারা গেল, সেই দোষী। যারা তাকে হত্যা করলো তারা নিষ্পাপ। সে রেলে না উঠলে তো তাকে হত্যা করা হতো না। তার সঙ্গে একটি ল্যাপটপ ছিল, সেটা না থাকলে তো এমনটা ঘটতো না।

অনেক দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে এমন কথা আমি শুনেছি। হজম করতে হয়েছে, অসহায় একজন পিতা হিসাবেই করতে হয়েছে। রিফাতের পরিবারকেও এসব কথা হজম করতে হবে। রিফাতের সদ্য স্বামীহারা স্ত্রীকেও সহ্য করতে হবে অসম্ভব রকম কুকথা।

রামছাগলের দল তার জীবনটাকেই হয়তো নরক বানিয়ে দেবে। রাস্তায় রাস্তায় ছড়াবে বউয়ের প্রেমের কারণেই স্বামী মারা গেছে। আর এই কল্পকাহিনীতে তলিয়ে যাবে দুই ভয়ংকর খুনি। যারা প্রকাশ্যে শত লোকের সামনে একজন মানুষকে এতটা নির্মমতার সঙ্গে হত্যা করতে পারে।

অনেকে অবশ্য বলছেন, এতগুলো লোকের সামনে কিভাবে মাত্র দুজন লোক এই হত্যাকাণ্ড ঘটালো। তাদের বলি, যে দুজন লোক এ কাজ করেছে তারাই একমাত্র সেখানে জীবিত মানুষ ছিল। আর সব মৃত। যে ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের দেশে ছড়িয়ে গেছে, তার প্রভাবে সব মানুষ এখন মৃত, অনুভূতিহীন।

মুখ বুজে সবাই নিজের কাজ করে যাচ্ছে, আর খেয়ে-পড়ে, বেঁচে-বর্তে রয়েছে। এটাই তাদের কাছে বড়, তারা তো বেঁচে আছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো কতদিন। প্রতিবাদহীনতার শেষ মানুষটা আপনিও হতে পারেন। আপনি প্রতিবাদ করেননি, আপনার সময়ও কথা বলার কেউ থাকবে না। তাই বারবার আউরাই, ‘দ্যায়ার ওয়াজ নো ওয়ান লেফট টু স্পিক’ কথাটি। কিন্তু বধির হয়ে যাওয়া কানে এসব কথা ঢোকে না।

আজকে রিফাতের পরিবার, রিফাতের স্ত্রী যে অবস্থায় রয়েছে। সেই অবস্থায় আমিও। খুনের শিকার আমার ছেলেও। অনেকে হয়তো বলবেন, আপনি বা রিফাতের পরিবার আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত বলেই এমনটা বলছেন। জবাব দিই, দীর্ঘদিন ধরেই আমি এটা বলে আসছি। বহু লেখায় বলেছি, ঝোপঝাড়ে মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে, ডোবায়-নালায়-নদীতে ভাসছে মানুষের লাশ। চারিদিকে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল। এ মিছিল থামাতে হবে।

ভাবতে পারিনি আমার ছেলেটাকেও পাওয়া যাবে অমন অবস্থাতেই। তাকেও বেওয়ারিশ ঘোষণা করে কবরস্থ করার প্রক্রিয়া চলবে। তাও আমাদের ভাগ্য ভালো যে, ছেলেটার মৃতদেহটা অন্তত পেয়েছি। কবরের পাশে বসে হতভাগ্য বাবা-মা কাঁদতে পারি। অনেকের ভাগ্যে তো কাঁদার সুখটাও জোটেনি। অনেকেই নিখোঁজ এখনো। রিফাতের পরিবারও অন্তত কাঁদার সুখটা পাবে। আর একপাল মানুষ যারা মৃত্যুর পরপরই মৃতকে দোষী বানাতে বসে যান। তাদের বলি, এমন দুঃসময়ের মুখোমুখি যদি কখনো হন, সন্তান-ভাই-স্বজন হারান, তখন বুঝবেন আপনাদের এই দোষী বানানোর প্রকল্প কত নির্মম ছিল, কতটা অমানবিক ছিল।
সুত্রঃ যুগান্তর

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)