পাথরঘাটার বিএফডিসি থেকে শত কোটি টাকা আত্মসাত, মুকুট বিহীন ইয়াবা সম্রাটের রাজ্যে হানা

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ০১:০৯ এএম, ১৭ জানুয়ারী ২০২১

মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল
দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পাথরঘাটা বিএফডিসিতে গত ১০ বছরে কয়েক’শ কোটি টাকার হাতিয়ে নেয়ার তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি একটি চক্র জিম্মি করে এই অনিয়ম চালাচ্ছে মর্মে সংশ্লিষ্টরা লিখিত অভিযোগ দেয় স্থানীয় সংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমনের কাছে। লিখিত অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান চালায় সাংসদ রিমন। বেরিয়ে আসে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির আলামত। এতে নাম উঠে আসে পাথরঘাটা পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের।বিষয়টি নিয়ে যতই অনুসন্ধান চালায় ততই অনিয়মের তথ্য ও প্রকাশ পেতে থাকে।

দেশের দক্ষিনাঞ্চলের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসি। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় এ মৎস্য বন্দরটি পরিচালিত হয়ে আসছে । মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় ১৯৮১ সালে নির্মিত । সেই থেকে বঙ্গোপসাগর, বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদীসহ তৎসংলগ্ন নদ-নদীর মাছ বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটে এসে বিক্রি করা হয়। এই ঘাটে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রিহয়। এর থেকে প্রচুর পরিমাণ সরকার রাজস্ব আহরণ করে থাকেন।

এই মৎস্য অবতরণটিকে কেন্দ্র করে ট্রলার মালিক সমিতি, মাঝি সমিতি, আড়ৎদার সমিতি, পাইকার সমিতি, ঘাট শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট,
লৈট্টা সমিতি, বরফ সমিতি, ভ্যান সমিতি, ককশেড সমিতি, হুক সমিতি, ঝুড়ি সমিতি, বেলচা সমিতি সহ নামে-বেনামে কয়েকটি সমিতি গড়ে ওঠে। যার সকল কিছুর প্রধাননেতৃত্বে ছিল মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এই সংশ্লিষ্ট সকল সমিতির নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন সাংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমন। শুনেছেন তাদের অভিযোগগুলো। এতে করে বেরিয়ে আসে কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাতের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সকল সমিতি ভেঙ্গে আহব্বায়ক কমিটি গঠন করে বিএফডিসিকে স্বাধীন ঘোষণা দেন তিনি।

আড়তদার সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর জমাদ্দার জানান, আমি সমিতির সভাপতি ছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণ করত মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। আমরা তাঁর কাছে জিম্মি হয়ে ছিলাম। সে যখন যেভাবে চালাতো সেভাবেই চলতো। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে এমপি রিমনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করলে কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলে।

এতো‌ টাকা আয়ের উৎস ছিল মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নামে-বেনামে বিভিন্ন সমিতি। এই সমিতির নাম ভেঙ্গেই প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতো মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত টাকা আদায়, ককশেট প্রতি নির্ধারিত টাকা, ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের উন্নয়নের নামেও প্রতিদিন আদায় হতো কয়েক লাখ টাকা।

এসময় ব্যাবসায়ীরা এমপি রিমনের কাছে অভিযোগ করেন , মাছ কিনতে হলে সোহেলকে সব পাইকার প্রতি মণে ৩শ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে পাইকারদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫/২০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। তার চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষা পায় না খেটে খাওয়া দিনমজুররাও। অভাব যাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় সেই দিনমজুরদের শরীর ঘাম বিক্রি করে নিজের পকেট ভরেন সোহেল।

তার সংগঠনের সদস্য ব্যতীত কোন শ্রমিক ঘাটে কাজ করার সুযোগ পায় না। আর যারা সদস্য হয় তাদের দৈনিক মজুরি ৬০০/৭০০ হলেও দিন শেষে ভাগ্যে জোটে মাত্র ২০০/৩০০ টাকা। এর প্রতিবাদ করলে শ্রমিকদের ঘাটে কাজ করতে দেয় না সোহেল। সাথে তাদের বিএফডিসি ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য পদ বাতিলে হুমকি দামকি দেয়, মাছ ক্রয়-বিক্রয়ের সময় আড়তদারদের কাছ থেকে প্রতি লাখে নেয়া হয় ৫০০ টাকা। বরফ ব্যবসায়ীদের দিকেও কুদৃষ্টি রয়েছে সোহেলের। ক্যান প্রতি চাঁদা দিতে হয় ৩০ টাকা।

পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ বহন করতে হলে কার্টুন প্রতি ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় সোহেলকে। ইলিশ মাছ পরিবহনের সময় ট্রাক প্রতি চাঁদা দিতে হয় ২ হাজার টাকা। শ্রমিকদের ঠকিয়ে পরিবহনের লেবার জামালের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করা হয়। তার সংগঠনের প্রায় এক হাজার সদস্যের কাছ থেকে জবাবদিহিতা ছাড়াই বছরে আদায় করা হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। বিনা কারণে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করে নতুন শ্রমিক অন্তর্ভুক্তির নামে আদায় করা হয় বিপুল অংকের টাকা।

শ্রমিকদের বিলের টাকার থেকেও শতকরা ১০ ভাগ যায় সোহেলের পকেটে। আর শ্রমিকের দৈনিক কালেকশন খাতা থেকেও মোটা অংকের টাকা চাঁদা হিসেবে নিয়ে নেয় সোহেল। শুটকির আড়তেও রয়েছে সোহেলের আধিপত্য। আড়তদাররা মাথাপিছু ১০/২০ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে বাধ্য থাকে। শুধু চাঁদা নয়, ধারের নামেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় অর্থ। আর সেই অর্থ ফেরত চাইলে হুমকির মুখে পড়তে হয় তাদের।

কয়েক শতাধিক মৎস্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে এমপি রিমনের কাছে পাইকার সমিতির সভাপতি আলম মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শহিদ মোল্লা জানান, তাদের কাছ থেকে সোহেল ১০ লাখ ধার হিসেবে নিলেও সেই টাকা এখনো ফেরত পায়নি তারা। একইভাবে বরফ ভ্যান সমিতির সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক জলিল মিয়ার থেকে ৭ লাখ টাকা ধার নেয় সোহেল। তবে সেই টাকার কোন কুল কিনারা হয়নি আজও। এ ছাড়া খাবার মাছ হিসেবে প্রতি আড়ত থেকে তার পছন্দ মতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মাছ নিয়ে যায়।

পাথরঘাটা বিএফডিসি মাছ বাজারের পাইকার সমিতির সভাপতি সাফায়েত হোসেন জানান, পাথরঘাটা বিএফডিসি মাছ বাজারে ৭৪ আড়তদার ও ৫২ পাইকার রয়েছেন। সোহেলের একক আধিপত্যের কাছে জিম্মি সব আড়তদার ও পাইকার। সাফায়েত বলেন, মাছ কিনতে সোহেলকে সব পাইকার প্রতি মণে ৩শ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এর প্রতিবাদ করলে শ্রমিকদের ঘাটে কাজ করতে দেয় না সোহেল। প্রতিদিন এই বাজার থেকে প্রায় ৫০/থেকে ৭০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে যায় সে। এ ছাড়া খাবার মাছ হিসেবে প্রতি আড়ৎ থেকে তার পছন্দ মতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মাছ নিয়ে যায়। ইলিশ মৌসুমে আরও বেশি নেয়। বাংলাদেশ মৎস্য কর্পেরেশন পাথরঘাটা বাজারের বড় বড় মাছ বাছাই করে নিজের প্রভাব খাটিয়ে সেগুলো প্রভাবশালীসহ প্রশাসনের আমলা ও এমপি মন্ত্রীদের আমলাদের ম্যানেজ করে সে।

বিএফডিসিতে সোহেলের এ আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করতে তার রয়েছে নিজ হাতে গড়া একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। যারা প্রতিদিন বি এফ ডিসিতে প্রকাশ্যে মদক সেবন, ধর্ষন, মারপিট সহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থেকে সোহেলকে সহোযোগীতা করে, বিনিময়ে তাদের রয়েছে শ্রমিক ইউনিয়নে সদস্য পদ, যাতে কোন প্রকার কাজ করা ছড়াই সাধারন শ্রমিকের শ্রমের অর্থ থেকে বিশাল অংকের ভাগ পান পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)