বরগুনায় যেভাবে ৯ মাস পর হত্যারহস্য উন্মোচন করলেন তিন গোয়েন্দা

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১

ছবিঃ সংগ্রহীতনিজেদের মতো তদন্ত চালিয়ে একটি হত্যারহস্য উন্মোচন করলেন যারা, তারা পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা নন। তারা নিতান্তই সাধারণ তিন তরুণ। ঘটনাচক্র পাওয়া একটি ক্লু থেকে বহুদিন আগের একটি সাধারণ মৃত্যুর নেপথ্য কাহিনি খুঁড়তে শুরু করেন তারা।

বরগুনার স্কুলশিক্ষক নাসির হত্যা রহস্য উদঘাটন হয়েছে একটি মুঠোফোনের কল রেকর্ডের সূত্র ধরে। সেটি রাজু মিয়া নামে ২০ বছর বয়সী এক যুবকের হারিয়ে যাওয়া মুঠোফোন। সেই ফোনটি পেয়েছিলেন ওই শহরেরই এক দোকানদার। আর ঘটনাচক্রে তারও নাম রাজু।

গত বছরের ২৩ মে রাতে বরগুনার নিজ বাড়িতে মারা যান গোলবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ৪৬ বছর বয়সী নাসির। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার স্ত্রী ফাতেমা মিতু জানিয়েছিলেন, স্ট্রোক।

ঘটনার নয় মাস পর উদঘাটন হয়, অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু নয়, তাকে হত্যা করা হয়েছে। মিতু ও রাজু পরস্পর যোগসাজশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান।

ঝুঁকি নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যে তিন তরুণ এই হত্যাকাণ্ড উন্মোচন করেন, তারা কোনো প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্য নন। তারা তিন বন্ধু। কুড়িয়ে পাওয়া একটি ফোনের সূত্র ধরে ঘটনাচক্রে কীভাবে এই রহস্য উদঘাটন হলো, তা এক রোমাঞ্চকর গল্প। এই তিন যুবকের সঙ্গে কথা বলে নেপথ্যের গল্পটি জেনেছে নিউজবাংলা।

ঘটনার শুরু গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রাজু নামে বরগুনা সদরের এক দোকানদারের দোকান থেকে।

তিনি বলেন, দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলাম হেঁটে। রাস্তায় ফোনটি পড়ে থাকতে দেখে তুলে নেই। চার্জ ছিল না তাই বন্ধ ছিল ফোনটি। বাসায় গিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেই।

ফোনটি বন্ধ ড্রয়ারেই পড়ে ছিল মাস দেড়েক। তবে একদিন রাতে মশার কয়েল খুঁজতে গিয়ে ড্রয়ারে রাখা ফোনটি আবার চোখে পড়ে রাজুর। তিনি চার্জে দিয়ে রাখেন।

দোকানদার রাজু বলেন, সকালে ফোন অন করে দোকানে আসতেই একটি কল আসে। কল রিসিভ করার পর এক তরুণ ওই ফোনের মালিকানা দাবি করে ফোনটি ফেরত চান। আমি তাকে দোকানে এসে পরিচয় দিয়ে ফোনটি ফেরত নিতে বলি। কিন্ত তিনি পরিচয় না দিয়ে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা অফার করেন। বলেন, ফোনটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলে তিনি নিয়ে নেবেন।

এভাবে পরিচয় গোপন রাখা এবং অযাচিতভাবে টাকার প্রস্তাব দেয়ায় সন্দেহ উঁকি দেয় দোকানদার রাজুর মনে। তিনি ফোনের মেমোরি ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি সেখানে পেয়ে যান কিছু রেকর্ড করা ফোনালাপ। রেকর্ড শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান।

রাজুর ভাষ্য, রেকর্ডগুলো শোনার পর আমি নিশ্চিত হই যে, নাসির নামে কোনো এক স্কুলশিক্ষককে হত্যা করেছে তারই স্ত্রী ও সেই স্ত্রীর পরিচিত রাজু নামের এক ব্যক্তি। হতবাক হয়ে যাই। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার নামও রাজু, ফোনটাও আমার কাছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। দিশেহারা হয়ে পড়ি আমি। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়।

ভয় পেয়ে বিষয়টি চেপেই যেতেন দোকানদার রাজু। কিন্তু মনের ভেতর একটি চাপা পড়া কৌতুহল কিলবিল করতে থাকে। একদিন বন্ধু ইয়াকুব দোকানে এলে তিনি গল্পচ্ছলে ঘটনা খুলে বলেন। সেইসঙ্গে রেকর্ডগুলোও তিনি শোনান বন্ধুকে। তারা দুজন মিলেও ঠিক করতে পারছিলেন না কী করা যায়, কী করা উচিৎ।

এমন নির্মম একটি হত্যাকাণ্ড চাপা পড়ে থাকবে? অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে? রাজু বলেন, পরে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইয়াকুবের বন্ধু নাজমুল। আমি দোকানে থাকি। নাজমুল ও ইয়াকু্ব বিষয়টি নিয়ে ঘাটতে শুরু করে।

ইয়াকুব বলেন, আমি একটি ঋণদান সংস্থায় চাকরি করি। দোকানদার রাজু আমাদের ঋণগ্রহিতা। বিষয়টি আমার সঙ্গে আলাপ করার পর রেকর্ডগুলো আমি শুনি। আমরা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেই ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। হত্যাকারিদের অনুসন্ধানে নামেন তিন বন্ধু।

নাজমুল বলেন, প্রথমে আমরা ফোনের মালিক রাজুকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি। অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রাজুর কাছে পৌঁছাই আমরা।

২০ বছর বয়সী রাজু মিয়া ঢলুয়া ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার বারেক মিয়ার ছেলে। সেই রাজু মিয়াকে রেকর্ডগুলো শোনান তিন বন্ধু।

নাজমুল বলেন, রেকর্ডগুলো শোনানোর পর নাসিরের স্ত্রী মিতুর ষড়যন্ত্রে তিনি এ হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। কৌশলে আমরা রাজুর স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ধারন করে রাখি। রাজু যাতে পালিয়ে না যায় এ জন্য আমরা তাকে সমঝোতার আশ্বাস দিয়ে নজরে রাখি।

এরপর তিন বন্ধু খুঁজে বের করেন নিহত নাসিরের বাড়ি। নাসিরের ভাই জলিলের সঙ্গে কথা বলেন তারা। রেকর্ডগুলো তাকে শোনান। কিন্তু আইনের আশ্রয় নিতে কিছুটা অনিহা দেখান জলিল। হতাশ হয়ে পড়েন তিন বন্ধু। কিন্তু থেমে যাননি। তারা এবার নিহতের স্ত্রী মিতুর সন্ধানে বের হন। বরগুনা শহরের থানাপাড়া এলাকায় বাবার বাসায় থাকেন মিতু। স্বামীর মৃত্যুর পর বাসার আসবাবপত্র সরিয়ে বাবার বাড়িতে উঠে গেছেন তিনি।

নাজমুল বলেন, আমরা মিতুর বিয়ের প্রস্তাবের জন্য খোঁজ নিচ্ছি এমন কৌশল অবলম্বন করে তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকি। পরে মিতুর বাবা বারেক মোক্তারের সঙ্গে দেখা করে রেকর্ডগুলো তাকে শোনাই।

এসব শোনার পর বারেক মোক্তার বলেন, আমার মেয়ে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আপনারা পুলিশে ধরিয়ে দেন। ওইদিন সন্ধার পর একজন গণমাধ্যমকর্মীর শরণাপন্ন হয়ে তার মাধ্যমে আমরা রেকর্ডগুলো নিয়ে থানায় যাই।

রাজুর স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও, কল রেকর্ড ও সমস্ত তথ্য থানা পুলিশের কর্মকর্তার হাতে তুলে দেন তিন বন্ধু। পুলিশ আর দেরি করেনি। ওই রাতেই মিতু ও রাজুকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে রাজু ও মিতু উভয়েই পুলিশের কাছে নাসিরকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম তারিকুল ইসলাম জানান, স্ত্রী মিতু তার স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রেমিক রাজুর সহায়তায় কম্বলচাপা দিয়ে হত্যা করেন।

কেন স্বামীকে হত্যা করলো মিতু? মিতু ও রাজুর কথোপকথনের ১৩টি অডিও ক্লিপেই বোঝা যায়, হত্যার মোটিভ। বোঝা যায়, ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে এবং টিকটক ও লাইকির ভিডিও তৈরিতে বাধা দেয়ায় স্বামীর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন মিতু। তাই তাকে মারতে লোক ভাড়া করেছিলেন তিনি।

রাজু, ইয়াকুব ও নাজমুল তিন বন্ধুরই দাবি, ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক এবং শাস্তি হোক অপরাধীদের। তবে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও কিছুটা শঙ্কিত তারা।

বলেন, আসামিরা ছাড়া পেলে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। আমরা সুরক্ষা চাই।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)