অবশেষে নিখোঁজ আইনজীবী বাবু সোনার লাশ উদ্ধার : স্ত্রী ও প্রেমিক গ্রেফতার

নোমান আল সাকিব
নোমান আল সাকিব, ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১১:৪৯ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১১:৫৮ এএম, ৫ এপ্রিল ২০১৮

---
রংপুর: ধারণা করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষী হওয়ায় এবং ইসলামি উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে মামলা লড়ায় নিখোঁজ হয়ে থাকতে পারেন রংপুরের আইনজীবী রথীশ৷ তবে লাশ পাওয়ার পর র‌্যাব জানালো, স্ত্রী’র পরকীয়ার জেরে খুন হয়েছেন তিনি৷

নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে র‌্যাব রংপুর শহরে রথীশের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকার নির্মাণাধীন একটি বাড়ি থেকে লাশটি উদ্ধার করে৷ এর আগে রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক এবং দীপার সহকর্মী কামরুল ও মতিয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ সোমবার তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলাম ও মতিয়ার রহমানকে আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়৷

রথীশের ভাই সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক সুবল লাশটি তার ভাইয়ের বলে শনাক্ত করেছেন৷ রথীশের স্ত্রী দীপাকেও সেখানে নিয়ে গিয়েছিল র‌্যাব৷
ঘাতক স্ত্রীর সাথে নিহত আইনজীবী রথীশচন্দ্র (বাবু সোনা)
র‍্যাব জানায়, প্রাথমিক তদন্ত ও তার স্ত্রীদের দেয়া স্বীকারোক্তি মতে, দুই মাস আগেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ২৬ মার্চ রাতে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাবু সোনার স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিকের সহকর্মী ও পরকীয়া প্রেমিক কামরুল ইসলামের নির্দেশে মাত্র তিনশো টাকার বিনিময়ে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সবুজ ইসলাম ও রোকনুজ্জামান তাজহাট মোল্লাপাড়ায় নির্মাণাধীন ভবনের খোলা রুমের বালু খুড়ে রাখে। কামরুল মাস্টার তাদের শিক্ষক হওয়ায় তারা এ আদেশ পালন করে।

র‍্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার (২৯ মার্চ) রাত ১০ টার দিকে স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক বাবু সোনাকে ভাত ও দুধের সাথে ১০ টি ঘুমের বড়ি খাওয়ানোর পরে তিনি অচেতন হয়ে পড়লে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে শয়ন কক্ষে কামরুল মাস্টার প্রবেশ করেন। পরে স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক ও প্রেমিক কামরুল মিলে বাবু সোনার গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে শয়নকক্ষের আলমিরাতে লাশ রেখে দেয়। পরের দিন শুক্রবার (শুক্রবার) ভোর ৫ টায় শয়ন কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় কামরুল। সকাল ৯ টায় কামরুল মাস্টার লাশ গুম করার জন্য একটি ভ্যান নিয়ে আসে এবং আলমারি ঠিক করার কথা বলে ভ্যানে করে আলমারিতে থাকা লাশ নিয়ে আগে থেকে মাটি খুড়ে রাখা আধা কিলোমিটার দূরে তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকায় কামরুলের ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে বেলা ১১ টার দিকে লাশ বস্তাতে ভরে পুতে রাখে। এ সময় সবুজ ও রোকনুজ্জামান তাদের শিক্ষকের কথামতো মাটি চাঁপা দেওয়া জায়গা সমান করে রাখে।তারা আরও জানান, কি ধরনের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে তা মেডিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে পরে জানা যাবে। আমরা আশাকরি এ ঘটনার সাথে জড়িতের আইনের আওতায় নিয়ে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এই গর্ততেই পুতে রাখা হয়েছিল বাবু সোনার লাশ
বুধবার দুপুরে রংপুরের র‌্যাব-১৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বাহিনীর মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘‘৩০ মার্চ সকাল থেকে রথীশচন্দ্রের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি ছিল ‘তার স্ত্রীর সাজানো নাটক’৷ হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই কৌশলে সবার নজর তিনি ভিন্ন দিকে সরানোর চেষ্টা করেছেন৷” তিনি আরও জানান, ‘‘দীপা ভৌমিকের সঙ্গে তার স্কুলের সহকর্মী কামরুল ইসলামে পরকীয়া প্রেম চলছিলো৷ এ নিয়ে রথীশের সঙ্গে দীপার কলহ লেগেই থাকতো৷” র‌্যাব জানিয়েছে, কামরুল তার দুই ছাত্রকে ৩০০ টাকা করে দিয়ে ওই গর্ত খোঁড়ার কাজটি করিয়েছিলেন৷ তাদেরও র‌্যাব আটক করেছে৷ জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, শিক্ষকের নির্দেশে তারা ওই কাজ করেছে৷

রংপুরের ডিআইজি খন্দকার ফারুক জানান, গত ৩০/৩/১৮ তারিখ হতে তিনি নিখোঁজ হন।নিখোঁজ হওয়ার পর সবাই বলাবলি করছিলো,তিনি যেহেতু জঙ্গি মামলার পিপি ছিলেন,তাই জঙ্গিরাই তাকে অপহরণ করেছে। কিন্তু ঘটনাস্হল পরিদর্শনের পরই বুঝতে পারি,ঘটনার পিছনে পরকীয়া আছে,তাই স্ত্রী কে মামলার বাদী না করে তার ভাইকে বাদী করা হয়।
প্রেমিক কামরুলের ভাইয়ের বাড়ি।যেখানে পুতে রাখা হয়েছিল বাবু সোনড় লাশ।
রংপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান বলেন, ৩০ মার্চ রথীশ চন্দ্র নিখোঁজ হওয়ার আগের রাতে ১০টা ২২ মিনিটে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। মঞ্চনাটকসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ওই সংগঠনের লোকজনেরা জানান, নিখোঁজ হওয়ার আগের রাতেই রথীশ চন্দ্র রংপুর টাউন হল মঞ্চে রাত নয়টা পর্যন্ত মঞ্চনাটক করেছেন এবং পাশে লালন উৎসব মঞ্চেও উঠেছিলেন।এরপর তিনি সাড়ে নয়টার দিকে বাড়ি যান। এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। ফোন বন্ধ হওয়ার ঘটনাটি ধরেই গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত শুরু করে। পরের দিন তাঁর স্ত্রী দাবি করেন, রশীথ চন্দ্র নিখোঁজ হয়েছেন। অজ্ঞাত মোটরসাইকেলে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এটি ছিল বানানো কথা।এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। স্ত্রীই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন।

প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্য সবাই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কিংবা জঙ্গি গোষ্ঠী কিংবা ভূমিদস্যুরা রথীশকে ধরে নিয়ে গেছে।এজন্য সোমবার জামাতের নেতা সহ সন্দেহভাজন নয়জনকে গ্রেপ্তার করে।

কিন্তু সোমবার তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলাম ও মতিয়ার রহমানকে আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন রথীশ। তার স্ত্রী দীপা এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৌহিদা খাতুন জানান।

২০১৫ সালে রংপুরের এক মাজারের খাদেম ইসলামি জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন৷ মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে  নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গিদল জামায়েতুল মুজাহিদীনবাংলাদেশ (জেএমবি)-র ৭ সদস্যকে ওই মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ রথীশ চন্দ্র ভৌমিক সেই মামলার সরকারপক্ষীয় আইনজীবী ছিলেন৷  এছাড়া তিনি জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যামামলারও প্রধান সরকারি কৌসুলি ছিলেন৷ সেই মামলাতেও ২০১৫ সালে ৫ জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একাত্তরের মানবতাবিরোধী র সাক্ষীও ছিলেন রথীশ৷ গত শুক্রবার থেকে তার সন্ধান ছিল না৷

আইনজীবী রথীশ রংপুরে নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন৷ তিনি রংপুরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক, আইনজীবী সমিতির সহ সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের ট্রাস্টি ছিলেন৷ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে রথীশকে খুঁজে বের করার দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করছিল৷

এন এ এস/পাথরঘাটা নিউজ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)