হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাবাংলাদেশের বাঁশি আর হ্যামিলনের বাঁশির সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছোটবেলায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প শোনেনি বা পড়েনি এমন কাউকে নিশ্চিতভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ইতিহাসে নামটা একেক জায়গায় ছিল একেক রকম, যেমন নামটা ছিল হ্যামিলন অথচ নামটা হবে হ্যামেলিন। সঙ্গীত ও হ্যামিলনের বাঁশির গল্পটা হঠাৎ আমাকে খুব উৎসাহিত করল। কারণ, এটা নিছক গল্প নয়, এর পেছনে রয়েছে কিছু কথা; আসলে কি ঘটনা সত্য? নাকি মানবসৃষ্ট কোনো গল্প? আসুন আমরা বিস্তারিত জেনে নিই।

আমরা ছোটবেলায় যে গল্পটা জেনেছিলাম, সেটি আরেকবার সংক্ষেপে বলব, তবে কাহিনির ভাঁজে যে নিঁখুত বর্ণনা আছে সেদিকে আমরা নজর দেবো।

জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনির হ্যামেলিন শহর। সালটা ছিল ঠিক ১২৮৪। হ্যামেলিন শহর তখন ইঁদুরের প্রকোপে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে যেন এসে হাজির হলেন এক বাঁশিওয়ালা। তার গায়ে ছিল হরেক রঙের পোশাক। এই বাঁশিওয়ালা ইঁদুরের অত্যাচার দেখে শহরের প্রধান ব্যক্তি মেয়রকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। মেয়র তার কথামতো রাজি হয়ে গেলেন। মেয়র mauldin বললেন ঠিক আছে, তুমি ইঁদুর তাড়াতে পারলে তোমাকে আমি ১ হাজার সোনার মুদ্রা দেবো। বাঁশিওয়ালা রাজি হয়ে গেল। তার বাঁশি বাজল আর সুড় সুড় করে সব ইঁদুর পিছন পিছন এসে তলিয়ে গেল শহরের পাশের weser নদীর পানিতে। তবে কিভাবে যেন একটি ইঁদুর বেঁচে গেল।

বাঁশিওয়ালা ফিরে এসে মেয়রের কাছে তার প্রাপ্য সোনার মুদ্রা চাইলেন। কিন্তু মেয়র তাকে ১ হাজার সোনার মুদ্রা দিতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করলেন। দিলেন মাত্র ৫০টি সোনার মুদ্রা। আর সাথে সাথে বলে বসলেন, তুমি নিজেই এই ইঁদুরগুলো এনেছিলে যেন তাড়িয়ে টাকা আয় করতে পারো। বাঁশিওয়ালা খুব দুঃখ পেলেন ও রাগ করে চলে গেলেন। যাবার আগে বাঁশিওয়ালা বলে গেলেন, তিনি এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বেন।

১২৮৪ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখ শহরে একটি অনুষ্ঠান চলছিল রোমের জন এবং পলের শহীদ হবার স্মরণে ‘সেন্ট জন পল দিবস’ পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি চলছিল, সেদিন সবাই ছিল চার্চে, যখন বাঁশিওয়ালা ফিরে এলো তবে এবার তার গায়ে ছিল না রঙ-বেরঙের পোশাক। তিনি পরে আসেন সবুজ রঙের পোশাক পরে। এই ঘটনার ফলে ‘সবুজ’ রঙকে তারা শিকারির রঙে আখ্যায়িত করে। তখন সকাল সাতটা। বাঁশিওয়ালা বাজাতে শুরু করল তার মায়াবী সুরে বাঁশি। সাথে সাথেই শহরের চার বছরের বড় সকল শিশু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আর গুনে গুনে ১৩০ জন শিশু বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরে সম্মোহিত হয়ে এক পাহাড়ের গুহায় ঢুকে গেল। আর বেরিয়ে এলো না। তাদের মধ্যে শহরের মেয়রের মেয়েও ছিল। তাদের নাকি নিয়ে যাওয়া হয় ট্রানসিলভানিয়াতে। এদের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে তিনজন শিশু বেঁচে যায়। তাদের একজন কানে শুনতে পেত না তাই সুর শোনেনি। আর একজন অন্ধ হয়ে জন্মাবার কারণে দেখতে পায়নি কোথায় যেতে হবে। আরেকজন জ্যাকেট নিয়ে আবার গিয়ে দেখে সবাই চলে গেছে বাঁশিওয়ালার সাথে সুরের মায়াজালে। এই তিন শিশুর মাধ্যমেই চার্চ ফেরত লোকজন জানতে পারল কী হয়েছে। আরেকটি বেবিসিটার মেয়ে কোলে শিশু নিয়ে পিছনে পিছনে দেখতে গিয়েছিল অনেকদূর, সে সবার আগে ফিরে এসে সবাইকে ঘটনাটি জানায়।

ঘটনার আরেক বর্ণনায় জানা যায়, শিশুদের নিয়ে বাঁশিওয়ালা চলে যায় কোপলবার্গ পাহাড়ের ওপারে। হয়তো ভাবছেন এটি নিছক এক গল্প। কিন্তু না, ১২৮৪ সালের ঘটনার পরেই চার্চে stained-glass জানালা লাগানো হয় ১৩০০ সালের দিকে। সেখানে এই করুণ ঘটনা লেখা ছিল। জানালাটা বানাবার উদ্দেশ্যই ছিল হারিয়ে যাওয়া শিশুদের স্মরণ করা। জানালাটা ধ্বংস হয়ে যায় ১৬৬০ সালে। পরে ইতিহাসবিদ হ্যাম্স ডবারটিন ঐতিহাসিক লেখা থেকে এই জানালা পুনঃনির্মাণ করেন। সেখানে দেখা যায় বাঁশিওয়ালা আর সাদা পোশাকে শিশুদের ছবি।

আমরা যে কারণে খ্রিস্টাব্দ বলি, যার মাধ্যমে খ্রিস্টের জন্ম স্মরণ করা হয়, তেমনই হ্যামেলিন শহরের সরকারি ঐতিহাসিক রেকর্ড শুরুতেই হয় এই ঘটনার রেফারেন্সে।

প্রথম যে এন্ট্রি লিপিবদ্ধ আছে, সেটি হলো ১৩৮৪ সালের লেখা- “১০০ বছর হতে চলেছে আমাদের শিশুদের হারিয়েছি’’। ১৫৫৯ সালের বিস্তারিত বিবরণ থেকে ইঁদুরের ঘটনা পাওয়া যায়। তার আগ পর্যন্ত শিশুদের হারাবার করুণ কাহিনি প্রাধান্য পাওয়ায় আগে ইঁদুরের ঘটনা প্রাধান্য পেত না।
শিশুদেরকে জাদুকর নিয়ে যাচ্ছে
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যদিও এই ঐতিহাসিক লেখা সংরক্ষিত আছে, তার পরেও এই অদ্ভুত ঘটনার বাস্তবিক ব্যাখা দিতে না পারায় অনেকেই অস্বীকার করে বসেন যে আদৌ এ ঘটনা ঘটেছিল। এখন পর্যন্ত কেউই এই ঘটনার সঠিক ব্যাখা দিতে পারেননি। কেউ বলেছেন, পাইড পাইপার আসলে এক শিশুকামী ছিল, তবে কিভাবে এতজন শিশুকে নিয়ে গেল তার ব্যাখা নেই। কারো মতে, ব্ল্যাক ডেথ মহামারিতে সব শিশু মারা যাওয়াতে গ্রামবাসী এই কাহিনি বানিয়েছে। কেউ বলেছে, এই শিশুদের ক্রুসেডে পাঠানো হয়েছিল, গ্রামবাসী যখন দেখল, শিশুরা আর ফিরে আসেনি, তখন এই ধাপ্পাবাজি গল্প ফেঁদে বসল নিজেদের সান্ত্বনা দিতে।

১৩৮৪ সালে হ্যামেলিনের ডেকান লুডের কাছে থাকা বইতে লাতিনে লেখা বাক্য তার দাদির ভাষ্যে নিজের চোখে দেখা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ঘটনা লিখিত ছিল। সতের শতকে এসে বইটি হারিয়ে যায়।

১৪৪০ সালের Luneburg পাণ্ডুলিপিতে জার্মান খোদাই করে লেখা এই অনুচ্ছেদ-

Anno 1284 AM Dage johnnis Et pauli Warder 26.Tunidorch Eienen piper Mit Allerley Farve Bekledet grewesen exxx kinder kerledet Binnen Hameln Getorento calvarie Bi Den Koppen keloren. অর্থ : ১২৮৪ সালের ২৬ জুন, সেন্টজন পাস দিবসে হ্যামেলিনের জন্ম নেয়া ১৩০ জন শিশু এক হরেক রঙ বংশীবাদকের সন্মেহনে পিছন পিছন হারিয়ে যায়। কোপেনের পিছনে কালভারিতে। কোপেন হলো হ্যামেলিনকে ঘিরে থাকা পাহাড়। ১৫৫৬ সালে বলা হয়, বংশীবাদক আসলে ছিল শয়তান। কালের বির্বতনে আধুনিক যুগে এসে কেউ কেউ বলেছেন- বাঁশিওয়ালা আসলে ছিল এক এলিয়েন, কোপেন পাহাড়ের ব্যাখ্যা- মহাকাশযান করে শিশুদের নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের গ্রহে। কারণ সেখানে জনসংখ্যা বাড়ানোর দরকার ছিল। নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির সুর বাজিয়ে কখনো ইঁদুর কখনো শিশু আর্কষণ করতে পারত তার যন্ত্র দিয়ে।

যদিও কখনো হ্যমেলিনের শহরে বেড়াতে যান, তবে দেখবেন- সেখানে বাঁশিওয়ালার মূর্তির সাথে ইঁদুর। ২০০৯ সালে তারা এক ‘টুরিস্ট ফেস্ট’-এর আয়োজন করে। শিশুদের প্রস্থানের কারণ ঘটনার ৭২৫তম বার্ষিকীতে যে বাড়িতে খোদাই করা ছিল ইতিহাসটি সেটিকে এখন ‘র‌্যাট ক্যাচার’-এর বাড়ি বলে। প্রতিবছর ২৬ জুন পালন করা হয় এই ‘র‌্যাট ক্যাচার দিবস’। আছে পাইড পাইপার থিম রেস্তোরা, আছে পাইড পাইপার মনোপলি। বর্তমানে আমরা যে যতখানি পাঠ্য বইতে পড়ি সেটা মূলত উপকথা শুনে গ্রিস ভাইদের পুনঃলিখন। শেষ যে রাস্তায় শিশুদের দেখা গিয়েছিল সে রাস্তার নাম ‘Bungelose nstrasse’ প্রেম ছাড়া রাস্তা, সেখানে কোনো মিউজিক বাজানো নিষেধ।

টাউন হলে এ বাক্যগুলো লেখা ছিল :

In the year 1284 after the birth at christ From Hamelin were led away

One hundred thirty children. Born at this place

Led away by a piper into a mountain.

বানানো হয় মুদ্রাও। আর বহু পরে বানানো মেইন গেইটে খোদাই করা ছিল- ‘১৩০ শিশুকে জাদুকর নিয়ে যাবার ২৭২ বছর পর এই ফটক নির্মিত হয়’। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা, গল্প আর উপন্যাস এমনকি ছায়াছবিও। অন্য দেশেও এর অনুকরণে রূপকথা চালু হয়ে যায়। কিন্তু হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার রহস্য আজও অমীমাংসিত যে, আসলে কী হয়েছিল সেই ১৩০ শিশুর ভাগ্যে।

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৩০ এপ্রিল

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)