ঘুরে এলাম মধুপুর শালবন - মোঃ শাহাবুদ্দীন

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৯:১৭ পিএম, ১৩ জুন ২০১৯

ঘুরে এলাম মধুপুর শালবন - মোঃ শাহাবুদ্দীনহাজার বছরের ঐতিহ্য মধুপুর শালবন। সুন্দরবন ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলের পর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন মধুপুর শালবন। এ বনকে দেশের মধ্যাঞ্চলীয় বনভূমিও বলা হয়ে থাকে। এ বনের বিস্তৃতি গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও মোমেনশাহী জেলার অংশজুড়ে। একসময় রাজধানী ঢাকার কাঁটাবন পর্যন্ত এ বনের সীমানা থাকলেও আজ তা শুধুই ইতিহাস। তবে টাঙ্গাইল ও মোমেনশাহী জেলার অংশটুকু মধুপুর গড় বা শালবন নামে পরিচিত। শালগাছের মোলা বা শিকড় থেকে গজানো চারায় গাছ হয় বলে স্থানীয়রা শালবনকে গজারী বনও বলে থাকে।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় রসূলপুর নামক স্থানে “মধুপুর জাতীয় উদ্যান” অবস্থিত।এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এ বনে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান বৃক্ষ শাল। এর আয়তন ২০,৮৪০ একর।জাতীয় উদ্যান ছাড়াও পীরগাছা রাবার বাগান, কাকরাইদ বীজ উৎপাদন খামার, হরিণ প্রজনন কেন্দ্র, জলছত্রে আদিবাসী রেশম বস্ত্র বিক্রয় কেন্দ্র-‘কারিতাস’, আদিবাসী পল্লী পর্যটকদের মুগ্ধ করে।মধুমাসে পুরো মধুপুর জুড়েই আনারসের প্রচুর চাষ হয়।এ সময় মধুপুর শুধু আনারসের রাজ্যই নয়, পর্যটন কেন্দ্রও হয়ে ওঠে। তাই মধুমাসে মধুপুর ভ্রমণের পরিকল্পনা একদম যুৎসই।

ভ্রমণ সম্পর্কে বাণী
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, “তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পুর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে।”

বিখ্যাত মনীষী সিনেকা বলেছেন, “সমুদ্রযাত্রা, ভ্রমণ এবং স্থান পরিবর্তন প্রাণশক্তি এনে দেয়।”

মধুপুরে যাত্রা
৮ জুন, ২০১৯ ইং ঢাকা থেকে গাজীপুর গেলাম। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বাসে মধুপুর উপজেলা। সেখান থেকে অটোতে রসূলপুর বাজার। এ বাজারের পাশে মধুপুর জাতীয় উদ্যানের প্রধান ফটক। রসূলপুরে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার ৮ কিঃ মিঃ পেছন দিকে, মধুপুর উপজেলার দিকে, পঁচিশ মাইল নামক স্থানে অটোতে আসলাম। ওখান থেকে ৯ কিঃ মিঃ দূরে অটোতে দোখলা পর্যটন স্পটে।
মধুপুর শালবনের ভিতরে যাওয়ার গেট
ওয়াচ টাওয়ার
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ হাঁটলে ওয়াচ টাওয়ার। ১০০ ফিট উঁচু। ১০ টাকা দিয়ে ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম। চারিদিকে কেবল বন আর বন, জঙ্গল আর জঙ্গল। টাওয়ারের সামনে একটা খোলা মাঠ।এক গারো ছোট ছোট আনারস বিক্রি করছে। আমি দু’টি কিনে খেলাম। লোক মুখে শুনলাম, এখানে একটি পার্ক হবে।কিছু দিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে। গত ১০ বছর আগে বিএনপি সরকারের আমলে মধুপুর জাতীয় উদ্যানের উন্নয়নের জন্য ২০০ কোটি টাকা বাজেট রেখেছিল এবং কিছু কাজও শুরু করেছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর উক্ত টাকা অন্যত্র ট্রান্সফার করে। আর কাজ হয়নি। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো এমনই, কেবল প্রতিহিংসা। পর্যটন কেন্দ্রের রাস্তাঘাট অনুন্নত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাজুক। বন কর্মকর্তা এবং প্রহরির সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। আধুনিক রেস্টহাউজ নেই।

হরিণ প্রজনন কেন্দ্র
বনের ঠিক মাঝখানে আছে একটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র। লহরিয়া বিট অফিস সংলগ্ন এই কেন্দ্রে দেখতে পাওয়া যায় চোখ জুড়ানো চিত্রা হরিণের বিচরণ। ওয়াচ টাওয়ার থেকে বনের ভেতর ৪ কিঃ মিঃ দূরে হরিণ প্রজনন কেন্দ্র। আমি ওই দিকেই হাঁটছিলাম। একটা অটোতে কয়েকজন যাত্রী। আমাকে তারা অফার দিলো। আমি ড্রাইভারের পাশে বসলাম। রাস্তা কাঁচা এবং কর্দমাক্ত। রাস্তার দু’পাশে শুধু শাল, কাঠাল, বাঁশ, আনারস, কলা, হলুদ, আদা, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম আর সবুজের সমারোহ। ঘন বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলার মজাই আলাদা।মনে হচ্ছে, আরেক বাংলাদেশে হারিয়ে গেছি।

বনের অভ্যন্তরে আছে নানান জাতের, নানা বাহারের গাছ-গাছরা, যেমন-শাল, বহেড়া, আমলকি, হলুদ, আমড়া, জিগা, ভাদি, অশ্বথ, বট, সর্পগন্ধা, শতমূলী, জয়না, বিধা, আজুকি/ হারগাজা, বেহুলা ইত্যাদি। আছে বিভিন্ন প্রজাতির পাহাড়ী আলু, শটি, আছে নাম না জানা বিচিত্র ধরণের লতা-গুল্ম। দর্শনীয় প্রাণীদের মধ্যে আছে অসংখ্য বানর, আছে নানান জাতের পাখ-পাখালি, হরিণ, বন বিড়াল, বনমোরগ, বাগডাসা ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগেও এ বনে বাঘ, মহিষসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি ছিল। কিন্তু বন বর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা, কাঠ চোর এবং দুর্বৃত্তদের দখলদারিত্বের কারণে অনেক প্রাণি হারিয়ে গেছে।

হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের সামনে অটো থামলো। ওখানে বানরও দেখা যায়। বানর সচরাচর দেখা গেলেও হরিণ সব সময় দেখা যায় না।মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। দৈনিক ২ বার বন কর্তৃপক্ষ হরিণকে খাবার দেয়, বেলা ১১ টা এবং বিকেল ৪ টা। উক্ত দু’ সময় নিশ্চিত হরিণ দেখা যায়। যিনি খাবার দেন তিনি ডাকলে হরিণ চলে আসে।
মধুপুর শালবনের আনারস
নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ
নিরাপত্তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।বন প্রহরীর সংখ্যা খুবই নগন্য। দু’চারজন যা-ই আছে, তা সারাদিন এক মুহুর্তের জন্যও দেখা পাই নাই। ফলে মাঝে-মধ্যেই পর্যটক দুর্ঘটনার শিকার হয়। তবে পর্যটক দলে দলে বনের ভেতর গেলে সমস্যা নেই। দু-একজন মূল রাস্তা থেকে শাখা রাস্তায় বা আরো গভীরে প্রেমলীলা করতে হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা করবেন না। মনে রাখবেন, এটা বলদা গার্ডেন না।

উদ্যানে জনবসতি
মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জনবসতি। তারা বেশিরভাগ গারো। উদ্যানের আশেপাশের এলাকাগুলো আদিবাসী (গারো) অধ্যুসিত গ্রাম। জনসংখ্যায় গারোর পরের স্থান মুসলিম। এছাড়া স্বল্প সংখ্যক হিন্দু পরিবারও আছে।

দুর্বৃত্তদের লুটপাট
মধুপুর জাতীয় উদ্যানের আয়তন ২০,৮৪০ একর। কিন্তু বন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় দুর্বৃত্তদের কারণে বনের পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।বিট অফিসারকে ঘুষ দিয়ে দুর্বৃত্তরা বন উজার করে আনারস, কলা, হলুদ, আদা, পেঁপে, কচু ইত্যাদির চাষাবাদ করছে। এই চিত্র যেমন মূল সড়কের পাশে দেখা যায়, তেমনি বনের ভেতর।এই বনে প্রতিবছর গাছ বিক্রি এবং কৃষি উৎপাদন হচ্ছে আনুমানিক ৫০ কোটির টাকার বেশি। এর সিংহভাগই অবৈধভাবে। বন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে এসব হচ্ছে। বন কর্মকর্তারা কী পরিমান অবৈধ সম্পদের মালিক, তা বন খেকো আবদুল গনীর দিকে তাকালে দেখতে পাই। ওয়ান ইলেভেনের সময় সে গ্রেফতার হয়েছিলো।

তবে সরকার কিছু প্লট সামাজিক বনায়নের আওতায় ১০ বছর মেয়াদী স্থানীয়দের (গারো, মুসলিম এবং হিন্দুদের) বরাদ্দ দিয়েছে। তবে এটা যৎ সামন্য। যা বরাদ্দ দিয়েছে তার বহুগুণ জবর-দখল করে ভোগ করছে দুর্বৃত্তরা। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

একজন বাগান মালিকের সাথে আলাপ করে জানলাম, আনারস এবং পেঁপের বাগানে তারা পোকা মারার জন্য কীটনাশক ব্যবহার করে। ফলের পরিমাণ বাড়ার জন্য এবং ফল পাকার জন্য (গাছে ফল থাকা অবস্থায়)ঔষধ ব্যবহার করে। ফল বৃদ্ধি এবং গাছে থাকা অবস্থায় পাকার জন্য ঔষধ ব্যবহার হয়, তা আমি আগে জানতাম না। ১০ লিটার পানিতে ১/২ চামচ ঔষধ। এ কারণে আনারসের বাগানের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করেছি। কিন্তু কোন ঘ্রান পাইনি। মোট কথা, আমরা বিষ খাচ্ছি।
মধুপুর শালবন ঘোড়ার গাড়ী
দোখলা রেস্ট হাউজ
দোখলা রেস্ট হাউজটি দোখলা গেটের পাশে। এটা সরকারী রেস্ট হাউজ। এ ছাড়া ২/৩ টি বেসরকারী রেস্ট হাউজ আছে।দোখলা রেস্ট হাউজ ১৯৬২-৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। এই রেস্ট হাউজটি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত।এখানে বঙ্গবন্ধু এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ১৯৭১ সালে ১৮ জানুয়ারি-২১ জানুয়ারি পর্যন্ত অবস্থান করেন।

আনারস
পুরো মধুপুর জুড়েই আনারসের প্রচুর চাষ হয়। তন্মধ্যে অরুণখোলা, ষোলাকুঁড়ি, আউশনাড়া ইউনিয়নে আনারসের সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। এসব ইউনিয়নের যে কোনো গ্রামে গেলে দেখা যাবে আনারসের নয়নজুড়ানো বিস্তীর্ণ ক্ষেত।এ এলাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় আনারস হল “জলডুগি”।
জলছত্র নামক স্থানে বসে আনারসের হাট।সূর্য ওঠার সাথে সাথে জমে ওঠে এই হাট। সুবহে সাদিকের পর পরই কৃষকরা আনারস নিয়ে হাজির হয় জলছত্র বাজারে। চারদিক থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা ঢাকা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কের দুই পাশে এসে জড়ো হচ্ছে। কেউ বাইসাইকেলে ঝুলিয়ে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে, কেউ পিকআপ ভ্যানে, কেউবা রিক্সা ভ্যানে করে ঠেলে-ঠুলে নিয়ে আসছে আনারস। এই আনারসের বাজার দেখলে আপনি কেবল মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবেন।

ফিরে আসা
দুপুরে দোখলা বাজারে খেয়ে অতঃপর বিকেলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মধুপুর শহরে গিয়ে দধি কিনে বিনিময় গাড়িতে চড়ে ঢাকা আসলাম।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)