অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ভেঙ্গে দেওয়া হলো সোহেলের রাজপ্রাসাদ

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ০৫:৫৬ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২১

অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ভেঙ্গে দেওয়া হলো সোহেলের রাজপ্রাসাদ

আগ থেকেই দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে মুকুট বিহীন সম্রাট মৎস্য ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল বিরুদ্ধে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির উপরে অবৈধ স্থাপনা উঠিয়ে রাজপ্রসাদ গড়ে তুলেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। সেই সাম্রাজ্য বরগুনার-২ আসনের সাংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমন এর উপস্থিতিতে গুড়িয়ে দিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

আজ বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ভাঙ্গা শুরু হয় সুরঙ্গ পথ গোপনে বহির্গমন পথ বিশিষ্ট আলিশান রাজপ্রাসাদ। আগামী ৭ দিনের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে সরকারি জমি উন্মুক্ত এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিগুলো বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেন শওকত হাসানুর রহমান রিমন।

এর আগে দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পাথরঘাটা বিএফডিসিতে গত ১০ বছরে কয়েক’শ কোটি টাকার হাতিয়ে নেয়ার তথ্য প্রকাশ পায়। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি একটি চক্র জিম্মি করে এই অনিয়ম চালাচ্ছে মর্মে সংশ্লিষ্টরা লিখিত অভিযোগ দেয় স্থানীয় সংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমনের কাছে। লিখিত অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান চালায় সাংসদ রিমন। বেরিয়ে আসে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির আলামত। এতে নাম উঠে আসে পাথরঘাটা পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের।বিষয়টি নিয়ে যতই অনুসন্ধান চালায় ততই অনিয়মের তথ্য ও প্রকাশ পেতে থাকে।

দেশের দক্ষিনাঞ্চলের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসি। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় এ মৎস্য বন্দরটি পরিচালিত হয়। মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতায় ১৯৮১ সালে নির্মিত হয়। সেই থেকে বঙ্গোপসাগর, বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদীসহ তৎসংলগ্ন নদ-নদীর মাছ বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটে এসে বিক্রি করা হয়। এই ঘাটে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রিহয়। এর থেকে প্রচুর পরিমাণ সরকার রাজস্ব আহরণ করে থাকেন।

এই মৎস্য অবতরণটিকে কেন্দ্র করে ট্রলার মালিক সমিতি, মাঝি সমিতি, আড়ৎদার সমিতি, পাইকার সমিতি, ঘাট শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট,
লৈট্টা সমিতি, বরফ সমিতি, ভ্যান সমিতি, ককশেড সমিতি, হুক সমিতি, ঝুড়ি সমিতি, বেলচা সমিতি সহ নামে-বেনামে কয়েকটি সমিতি গড়ে ওঠে। যার সকল কিছুর প্রধাননেতৃত্বে ছিল মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এই সংশ্লিষ্ট সকল সমিতির নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন সাংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমন। শুনেছেন তাদের অভিযোগগুলো। এতে করে বেরিয়ে আসে কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাতের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সকল সমিতি ভেঙ্গে আহব্বায়ক কমিটি গঠন করে বিএফডিসিকে স্বাধীন ঘোষণা দেন তিনি।

আড়তদার সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর জমাদ্দার জানান, আমি সমিতির সভাপতি ছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণ করত মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। আমরা তাঁর কাছে জিম্মি হয়ে ছিলাম। সে যখন যেভাবে চালাতো সেভাবেই চলতো। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে এমপি রিমনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করলে কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলে।

এতো‌ টাকা আয়ের উৎস ছিল মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নামে-বেনামে বিভিন্ন সমিতি। এই সমিতির নাম ভেঙ্গেই প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতো মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল। ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত টাকা আদায়, ককশেট প্রতি নির্ধারিত টাকা, ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের উন্নয়নের নামেও প্রতিদিন আদায় হতো কয়েক লাখ টাকা।

এসময় ব্যাবসায়ীরা রিমনের কাছে অভিযোগ করেন , মাছ কিনতে হলে সোহেলকে সব পাইকার প্রতি মণে ৩শ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে পাইকারদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫/২০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। তার চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষা পায় না খেটে খাওয়া দিনমজুররাও। অভাব যাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় সেই দিনমজুরদের শরীর ঘাম বিক্রি করে নিজের পকেট ভরেন সোহেল।

তার সংগঠনের সদস্য ব্যতীত কোন শ্রমিক ঘাটে কাজ করার সুযোগ পায় না। আর যারা সদস্য হয় তাদের দৈনিক মজুরি ৬০০/৭০০ হলেও দিন শেষে ভাগ্যে জোটে মাত্র ২০০/৩০০ টাকা। এর প্রতিবাদ করলে শ্রমিকদের ঘাটে ব্যবসা করতে দেয় না সোহেল। আর মাছ ক্রয়-বিক্রয়ের সময় আড়তদারদের কাছ থেকে প্রতি লাখে নেয়া হয় ৫০০ টাকা। বরফ ব্যবসায়ীদের দিকেও কুদৃষ্টি রয়েছে সোহেলের। ক্যান প্রতি চাঁদা দিতে হয় ৩০ টাকা।

পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ বহন করতে হলে কার্টুন প্রতি ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় সোহেলকে। ইলিশ মাছ পরিবহনের সময় ট্রাক প্রতি চাঁদা দিতে হয় ২ হাজার টাকা। শ্রমিকদের ঠকিয়ে পরিবহনের লেবার জামালের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করা হয়। তার সংগঠনের প্রায় এক হাজার সদস্যের কাছ থেকে জবাবদিহিতা ছাড়াই বছরে আদায় করা হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। বিনা কারণে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করে নতুন শ্রমিক অন্তর্ভুক্তির নামে আদায় করা হয় বিপুল অংকের টাকা।

শ্রমিকদের বিলের টাকা থেকেও শতকরা ১০ ভাগ যায় সোহেলের পকেটে। আর শ্রমিকের দৈনিক কালেকশন খাতা থেকেও মোটা অংকের টাকা চাঁদা হিসেবে নিয়ে নেয় সোহেল। শুটকির আড়তেও রয়েছে সোহেলের আধিপত্য। আড়তদাররা মাথাপিছু ১০/২০ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে বাধ্য থাকে। শুধু চাঁদা নয়, ধারের নামেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় অর্থ। আর ফেরত চাইলে হুমকির মুখে পড়তে হয় তাদের।

কয়েক শতাধিক মৎস্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে এমপি রিমনের কাছে পাইকার সমিতির সভাপতি আলম মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শহিদ মোল্লা জানান, তাদের কাছ থেকে সোহেল ১০ লাখ ধার হিসেবে নিলেও সেই টাকা এখনো ফেরত পায়নি তারা। একইভাবে বরফ ভ্যান সমিতির সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক জলিল মিয়ার থেকে ৭ লাখ টাকা ধার নেয় সোহেল। তবে সেই টাকার কোন কুল কিনারা হয়নি আজও। এ ছাড়া খাবার মাছ হিসেবে প্রতি আড়ত থেকে তার পছন্দ মতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মাছ নিয়ে যায়।

পাথরঘাটা বিএফডিসি মাছ বাজারের পাইকার সমিতির সভাপতি সাফায়েত হোসেন জানান, পাথরঘাটা বিএফডিসি মাছ বাজারে ৭৪ আড়তদার ও ৫২ পাইকার রয়েছেন। সোহেলের একক আধিপত্যের কাছে জিম্মি সব আড়তদার ও পাইকার। সাফায়েত বলেন, মাছ কিনতে সোহেলকে সব পাইকার প্রতি মণে ৩শ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এর প্রতিবাদ করলে শ্রমিকদের ঘাটে কাজ করতে দেয় না সোহেল। প্রতিদিন এই বাজার থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে যায় সে। এ ছাড়া খাবার মাছ হিসেবে প্রতি আড়ত থেকে তার পছন্দ মতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মাছ নিয়ে যায়। ইলিশ মৌসুমে আরও বেশি নেয়। মাছ দিয়ে প্রভাবশালীসহ প্রশাসন ও এমপিদের ম্যানেজ করে সে।

বিএফডিসিতে সোহেলের এ আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করে তার নিজ হাতে গড়া একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এই বাহিনীকে সবাই লইট্টা বাহিনী হিসেবেই চেনে। মাদক ব্যবসাসহ বিএফডিসির বিভিন্ন খাত থেকে প্রতি মাসে এভাবেই প্রায় কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেন তিনি।

আড়তদাড় মারুফ হোসেন জানান, শুধু সোহেল নয়! তার বাবা বিএফডিসি আড়তদার সমিতির কথিত সভাপতি নুরুল আমিনও অসহায় দিনমজুরদের ভাগ্য নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। লেবার অর্ন্তভুক্তির নামে নেয়া হয় জনপ্রতি ৬/৭ হাজার টাকা আর প্রতি বছর নবায়ণের জন্য নেয়া হয় ৫০০/১০০০ টাকা। যেখানে কাজ করার কথা ১০০ জনের সেখানে নিজের পকেট ভারী করতে নুরুল আমিন টাকার বিনিময়ে ভর্তি করান প্রায় ১২০০ জন লেবার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ অঞ্চলের মাদক কারবারি হিসেবে আলোচনায় সোহেল। পাথরঘাটার মুকুটবিহীন সম্রাটও বলা হয় তাকে। ধর্ষণ ও মাদকসহ তার বিরুদ্ধে পাথরঘাটা থানায় ১৩টি মামলা রয়েছে। গত পৌর নির্বাচনে তার আমলনামায় নিজেই এ তথ্য জমা দিয়েছেন নির্বাচন অফিসে। এ সব কিছুর পরেও প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষকে অবৈধ কালো টাকা আর ব্যাগ ভর্তি ইলিশ মাছ দিয়ে সবকিছুর আড়ালে থেকে যায় সোহেল।

সোহেল আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না থেকেও ১৯টি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সাধারণ সমপাদকের পদ দখল করে রয়েছেন। তিনি পাথরঘাটা বিএফডিসি পাইকারি মাছ বাজারের ঘাট শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি।

২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সোহেল মাছ বাজারে টোকাই হিসেবে এক নামে পরিচিত ছিলেন। ২০০৯ সালে সংসদ নির্বাচনের পর বিশিষ্ট শিল্পপতি গোলাম সবুর টুলু এমপি নির্বাচিত হলে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে প্রভাব খাটিয়ে ২০১০ সালে মাছ ঘাটের শ্রমিক নেতা হিসেবে সংগঠনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএফডিসি মৎস্য ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। আস্তে আস্তে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর পাথরঘাটা পৌরসভার প্রথম ধাপের নির্বাচনে সোহেল পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।‌ এরপরই প্যানেল মেয়র হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয়।

এ সব কিছুর সত্যতা স্বীকার করে বরগুনা ২ আসনের সাংসদ শওকত হাসানুর রহমান রিমন জানান, প্রয়াত এমপি গোলাম সবুর টুলুর সরলতার সুযোগ নিয়ে সোহেল বেপরোয়াভাবে বিএফডিসি এর রাজত্ব কায়েম করেন। অভিযোগের তদন্ত করে তার সকল অপকর্ম ফ্লিস্তি ফাঁস হয়ে গেছে। আমার জানা ছিলনা খুলনার এরশাদ শিকদার ও হারমানবে পাথরঘাটা নব্ব এরশাদ শিকদার সোহেলের কাছে।

এমপি রিমন আরো জানান, আগামী তিন দিনের মধ্যে সকল সমিতির আয় ব্যায়ের হিসাব চাওয়া হয়েছে। তবে কয়েক’শ কোটি টাকা আত্মসাতের করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অতিশীঘ্রই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ও জানান তিনি।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)