অভিভাবক ও রক্ষক

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ০৫:৪৮ এএম, ৩০ আগস্ট ২০১৮

অভিভাবক ও রক্ষক
আল্লাহ্‌ বলেন,

পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক ও রক্ষক এ জন্য যে, আল্লাহ্‌ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। [সূরাহ আন-নিসা (৪): ৩৪]

পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক ও রক্ষক বলতে কী বোঝায়? প্রশ্নটির উত্তরে আমাদের প্রথমেই সেই আরবি শব্দটি দেখতে হবে, যার অনুবাদ আমরা করছি “অভিভাবক ও রক্ষক”। শব্দটি হলো “ক্বাওয়ামূন”, যা “ক্বাওয়াম” শব্দের বহুবচন।

“ক্বাওয়াম” শব্দটি “ক্বাইয়িম” শব্দের জোরালো রূপ, যার অর্থ ব্যবস্থাপক। কোনো জনপদের ক্বাইয়িম বলতে বোঝায় যিনি তাদের ব্যবস্থাপনা করেন এবং তাদের কাজের দিকনির্দেশনা দেন। একইভাবে একজন নারীর ক্বাইয়িম হবেন তার স্বামী অথবা তার অভিভাবক, যিনি তার দেখাশোনা করেন এবং তার প্রয়োজন পূরণ করা নিশ্চিত করেন।

যখন আল্লাহ্‌ বলেন, “পুরুষ নারীর ক্বাওয়ামূন…” এর অর্থ দাঁড়ায় যে, পুরুষেরা নারীদের কাজের বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং তাদের অধীনস্থ নারীদের বিষয়ে দায়বদ্ধ। আল্লাহ্‌ই সর্বোত্তম জানেন। সুতরাং, একজন স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ, নিরাপত্তা, তার সম্মান রক্ষা এবং তার ধর্মীয় ও জাগতিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ। অনেক মানুষ মনে করে যে, এর অর্থ হলো স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি রুক্ষ আচরণ করবে, স্ত্রীকে স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করবে, স্ত্রীর নিজস্বতাকে খর্ব করবে, এবং হিংস্রভাবে তার পরিচয় অস্বীকার করবে। আসলে বিষয়টা মোটেও এরকম নয়।

পুরুষের অভিভাবক ও রক্ষক হওয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা; খুব বেশি কর্তৃত্বের অবস্থা না। তাকে তার কাজের ব্যপারে বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তার উৎকর্ষতা দেখাতে হয় এবং ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়। তার মানে দাঁড়ায়, সে তার সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়া বা অসভ্যতার ভাব আনবে না। সে তার স্ত্রীর মতামতকে উড়িয়ে দিতে এবং তার ভালো মানসিকতাকে ছোট করতে পারে না।

ইসলাম কেন পুরুষকে নারীর অভিভাবক ও রক্ষক হিসেবে গণ্য করে?

আয়াতটি থেকে আমরা পুরুষদের উপর এই গুরুভার দেওয়ার দুইটি কারণ পাই। আল্লাহ্‌ বলেন, “…এ কারণে যে, আল্লাহ্‌ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন…” এবং “…এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে।” নারীদের উপর পুরুষের প্রাধান্যের কথা বললে একটা সমস্যার উদ্ভব হয়। যেসকল সংস্থা, স্থাপনা এবং কর্মীরা নারীদের সমতার কথা বলে, তারা তখন সক্রিয় হয়ে উঠে ও ঝগড়া করার জন্য তৈরী হয়ে যায়। তারপর তাদের সকল চরমপন্থী কথাবার্তা প্রকাশ করতে শুরু করে। বরং তাদের একটু শান্ত হয়ে চিন্তা করার দরকার যে, আল্লাহ্‌ “…এ কারণে যে, আল্লাহ্‌ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন…” বলতে কী বুঝিয়েছেন। এর সঠিক ব্যাখ্যা কেবল কুরআন ও হাদীসের আলোকে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ থেকে বোঝা যাবে।

যারা নারীদের অধিকার নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তারা দাবি করে যে, মহিলারা ইসলামে নির্যাতিত এবং ইসলাম তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করে না। তারা কুরআন ও হাদীসের দলীলের বিরুদ্ধাচরণ করে। “সমতা”র নামে তারা আসলে নারী পুরুষের “সাদৃশ্যে”র দাবী করে। অথচ উত্তরাধিকার, শাসনভার ইত্যাদি নানা বিষয়ে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকি তারা কখনো কখনো ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, পুরুষদেরই নারীদের সাথে সমতা অর্জনের জন্য দৌড়াতে হয়!

ফিরে যেতে হয় আগের সেই আলোচনায়। আয়াতটিতে আসলে কী বলা হচ্ছে। এটা কি নির্দেশ করছে যে, নারীদের তুলনায় পুরুষদের কিছু সহজাত প্রাধান্য আছে, যা তাদের প্রকৃতিরই অংশ? কুরআনের তাফসীর বিশারদগণ এই ব্যপারে দুটি মতে অগ্রসর হয়েছেন।

প্রথম মত হলো, এই আয়াতটি নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক গড়নের দিকে নির্দেশ করে। নারী-পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, চিন্তাগত এবং সহজাত বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের দিকে নির্দেশ করে। তাঁদের মতে, পুরুষেরা সহজাতভাবে রগচটা, শক্তিশালী ও কঠোর স্বভাবের; অপরদিকে নারীরা সহজাতভাবে ঠাণ্ডা প্রকৃতির, নম্র ও দুর্বল স্বভাবের।

দ্বিতীয় মতে, বিষয়টিকে একটু শার’ঈ বিধি-বিধানের দিক থেকে দেখা হয়। যেমন, আল্লাহ্‌ পুরুষদের উপর বিয়ের জন্য নারীদেরকে মোহর প্রদান বাধ্যতামূলক করেছেন। নারীদের প্রয়োজনীয় খরচের জন্য পুরুষকে দায়িত্বশীল করেছেন। পুরুষেরা এই দিক থেকে নারীদের উপর প্রাধান্য রাখে। অনুরূপভাবে, আল্লাহ্‌ কেবল পুরুষদের মাঝেই নবুওয়্যাত সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কোনো নারী কখনো নবী ছিলেন না। অনুরূপভাবে, আল্লাহ্‌ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং জিহাদের দায়িত্ব কেবল পুরুষদের জন্য রেখেছেন।

এ প্রসঙ্গে, সাক্ষ্যপ্রদানের বিষয়টিও এখানে চলে আসে। আল্লাহ্‌ বলেন,

দুজন সাক্ষী কর, তোমাদের পুরুষদের মধ্যে থেকে। যদি দুজন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর; যাতে একজন যদি ভুলে যায়, তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। [সূরাহ আল-বাক্বারাহ (২): ২৮২]

এই মত পোষণকারীগণের একাংশ আবার বিষয়টিকে কিছু ইবাদাতের কাজের সাথে সম্পৃক্ততা হিসেবে দেখেছেন। যেমন জুমু’আর সালাত এবং জামা’আতের সালাত কেবল পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক, নারীদের জন্য নয়। এছাড়া একজন পুরুষের একইসাথে চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি আছে, যেখানে একজন নারী একইসাথে কেবল একজন স্বামীর স্ত্রী হতে পারবেন। আবার পুরুষের তাৎক্ষণিক তালাক প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। এগুলোকেও আয়াতটির ব্যাখ্যা হিসেবে ধরা হয়।

উপরোক্ত দুটি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমরা দুটি অনুসিদ্ধান্ত পেতে পারি-

প্রথমত, উভয় পক্ষই একটি বিষয়ে একমত যে, আল্লাহ্‌র কথামতো নারীদের উপর পুরুষের প্রাধান্য আছে “…এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে।”

দ্বিতীয়ত, উভয় পক্ষের মুফাসসিরগণ এই আয়াতটির ব্যাখ্যা নিজস্ব ইজতিহাদ থেকে বুঝেছেন। উভয়ক্ষেত্রেই এটা বলা যথার্থ হবে যে, আল্লাহ্‌ অবশ্যই পুরুষদের কিছু বিষয়ে আলাদা করেছেন। যেমন- নবুওয়্যাত, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা, জিহাদ এবং সামরিক কার্যকলাপ। এসবের কারণ হলো নারী-পুরুষের স্বভাবের ভিন্নতা। বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন সকলেই এই সিদ্ধান্তে একমত হবেন। ইসলাম যে নারীদের নিরাপত্তা ও তাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব পুরুষের ওপর আরোপ করেছে, তার যথার্থতা বুঝতে হলে নারী-পুরুষের স্বভাবের ভিন্নতা বিবেচনায় আনতে হবে। আর এই বিধানের উদ্দেশ্য হলো নারীদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করা।

আল্লাহ্‌র বিধানসমূহ সর্বদা সহজাত প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। মানবজাতির দুই অংশ তথা নারী ও পুরুষকে আলাদা আলাদা গুণাবলি উপহার দেওয়া হয়েছে, যা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনন্য। ইসলামের বিধান সেসব গুণাবলির সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করে।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, নারী-পুরুষ উভয়ই আল্লাহ্‌র সৃষ্টি। এবং আল্লাহ্‌ তাঁর সৃষ্টির উপর কখনো অবিচার করবেন না। তিনি তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে তিনি যেই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তৈরী করেন। আর তার মাঝে সেই সকল সহজাত যোগ্যতা দান করেন, যা সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রয়োজন।

আল্লাহ্‌ নারীদের জন্য এই বিশেষ যোগ্যতা দিয়েছেন যে, তারা গর্ভবতী হয়, সন্তান ধারণ করে এবং তাদের লালনপালন করে। অতএব, নারী সহজাতভাবেই নারী-পুরুষের মিলনের ফলে উৎপন্ন মাখলুকটির যত্ন নেয়ার দায়ভার প্রাপ্ত। আর এটি কিন্তু একটি বিশাল দায়িত্ব। এটি কেবল একটি গুরুদায়িত্বই নয়, বরং একইসাথে বেশ স্পর্শকাতর দায়িত্বও বটে। আল্লাহ্‌ নারীদের বিশেষ কিছু শারিরীক, মানসিক ও আবেগীয় বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। সেসবের গুরুত্ব উড়িয়ে দিয়েই যে কেউ সন্তান লালন-পালন করতে পারবে, এত সহজ নয় বিষয়টা।

অতএব এটিই স্বাভাবিক যে, নারীদের প্রয়োজন পূরণের এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আল্লাহ্‌ মানবজাতির অপর অর্ধাংশের তথা পুরুষের উপরই ন্যস্ত করবেন। সেইসাথে তিনি পুরুষদের সহজাত স্বভাব হিসেবে তাদেরকে সেসকল শারিরীক, মানসিক এবং আবেগীয় গুণাবলি দান করবেন, যা এ দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয়। আর এই দায়িত্ব পালনে যেহেতু টাকাপয়সার ব্যাপারস্যাপার আছেই, তাই আল্লাহ্‌ অবশ্যই পুরুষদের উপর তাদের অধীনস্থ নারীদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন। এই দুটি বিষয়ে মূলত আয়াতটিতে আলোকপাত করা হয়েছে।

এদিকে একটি মজার বিষয় আছে। যেসব মুফাসসির শার’ঈ বিধি-বিধানের দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের দেওয়া উদাহরণগুলোও পুরুষের উপরোক্ত সহজাত স্বভাবেরই ফল। নবুওয়্যাত, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামরিক দায়িত্ব, আযান দেওয়া, জামাতে সালাত আদায় করা – এই সকল দায়িত্ব পুরুষদেরই মানায়। কারণ তারা গৃহস্থালির দায়িত্বে ব্যস্ত না, যা কি না তাদের এসকল কাজে বাধা দিবে।

যদিও নবুওয়্যাত হলো সম্মানের সর্বোচ্চ পর্যায়, কিন্তু এই সম্মান পুরুষের অভিভাবক ও রক্ষক হওয়ার ‘কারণ’ নয়। তেমনি আযান, সালাতের ইমামতি, এবং জুমু’আর খুতবা এসব পুরুষদের দেওয়া হয়েছে ইসলামিক শারি’আতের ভিত্তিতে। কিন্তু এগুলোর ফলে নারীর উপর পুরুষের আলাদা কোনো ‘সম্মান’ প্রতিষ্ঠিত হয় না। আল্লাহ্‌ যদি এই দায়িত্বসমূহ নারীদের উপর আরোপ করতেন, তাহলেও অভিভাবক ও রক্ষকের দায়িত্ব পুরুষের উপর থেকেই যেত। অর্থাৎ, পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক ও রক্ষক হয়েছে তাদের সৃষ্টিগত প্রকৃতির কারণে। আলাদা কোনো সম্মানের কারণে না।

আবারও বলছি যে, পুরুষের এই দায়িত্ব কিছুতেই নারীদের নিজস্ব পরিচয়কে অস্বীকার করে না, হোক সেটা ঘরের ভিতর অথবা ঘরের বাইরে সমাজে। এটা কেবল এমন একটি দায়িত্ব যা পারিবারিক পরিবেশে পুরুষদের পালন করতে হয়, যাতে পরিবার নামক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানটিকে যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন ম্যানেজারের উপস্থিতি তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিপরিচয়কে অস্বীকার করে না অথবা তাদের অধিকার খর্ব করে না। অভিভাবকত্ব ও রক্ষকের দায়িত্ব কী কী, ইসলাম তা স্পষ্টভাবে বলে দেয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এই দায়িত্ব কীভাবে বাস্তবায়িত করেছেন?
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর পরিবারে কোনো স্বৈরাচারী শাসকের মতো ছিলেন না। আমরা উপরে যা বললাম, তাঁর জীবনীর দিকে তাকালে তারই মূর্ত রূপ দেখতে পাবো। অর্থাৎ, অভিভাবক ও রক্ষক হওয়ার অর্থ এই না যে, পুরুষ নারীর প্রতি রুক্ষ আচরণ করবে ও তাকে দাসী বানিয়ে রাখবে। আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) তাঁর স্বামীর ব্যাপারে বলেন,

যখন তিনি ঘরে থাকতেন, তখন তিনি ঘরের কাজে সম্পূর্ণ ব্যস্ত থাকতেন।

তিনি খুবই ক্ষমাপরায়ণ ছিলেন। তাঁর একজন স্ত্রী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) একবার মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখেন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর পাশে নেই। উল্লেখ্য, রুটিন অনুয়ায়ী সেই রাতে এই স্ত্রীর সাথেই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর থাকার কথা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বাইরে থাকা অবস্থায়ই তিনি ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট চলে গিয়েছেন। রাসূল ﷺ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দরজা বন্ধ দেখলেন। তিনি ﷺ দরজা খুলতে বললে উম্মুল মুমিনীন তাঁকে বাইরে যাওয়ার কারণ জেরা করলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ শান্তভাবে উত্তর দিলেন যে, তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বেরিয়েছিলেন।

অনেক সময় তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর সামনেই পরস্পর তর্ক-বিতর্ক করতেন। তিনি তাতে কখনোই রেগে যেতেন না। তিনি সর্বদা প্রজ্ঞা, ভদ্রতা ও নম্রতার সাথে তাঁদের সমস্যা সমাধান করতেন, কখনো রুক্ষ হতেন না। এতে আমরা দেখতে পাই অভিভাবক ও রক্ষক হিসেবে পুরুষের ভূমিকা আসলে কেমন হতে হয়।

একবার, তাঁর স্ত্রী হাফসা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) তাঁর সতীন সাফিয়াহকে (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) “ইহুদির মেয়ে” বলে তিরস্কার করেন। এটা সত্য যে সাফিয়াহর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বাবা হুবাই বিন আক্তাব একজন ইহুদি ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ না করেই মারা যান। তবুও এরূপ মন্তব্য সাফিয়াহর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) জন্য কষ্টদায়ক ছিলো, বিশেষত যখন তা তাঁর সতীন থেকে আসে। তাই তিনি যখন হাফসার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) এই মন্তব্য শুনলেন, তিনি কাঁদতে লাগলেন।

রাসূল ﷺ তখন এসে তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর দেন, “হাফসা আমাকে ইহুদির মেয়ে বলেছে।” এতে রাসূল ﷺ উত্তর দেন,

অবশ্যই তুমি একজন নবীর মেয়ে, তোমার চাচা আরেকজন নবী, এবং তুমি একজন নবীর স্ত্রী। অতএব তোমার উপর তার (হাফসা) গর্ব করার কী থাকতে পারে?

তারপর তিনি হাফসাকে (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বললেন,

আল্লাহ্‌কে ভয় কর, হাফসা।

অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল ﷺ সাফিয়াহর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) দিকে ঘুরে বললেন,

তো তুমি বলতে পারলে না, “তুমি আমার থেকে কীভাবে উত্তম? মুহাম্মাদ ﷺ আমার স্বামী, হারূন (‘আলাইহিসসালাম) আমার পিতা, মূসা আলাইহিসসালাম আমার চাচা।”

রাসূল ﷺ হাফসা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)-কে বিষয়টি অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখিয়ে বোঝালেন যে, তাঁর লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

যে কেউ ইসলামে পুরুষের রক্ষক ও অভিভাবক হওয়ার অবস্থানকে নারীর উপর অত্যাচার করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে, সে ইসলামের বিরূদ্ধাচরণ করছে।

ইসলাম নারীদের অধিকার নিশ্চিত করেছে, তাদের মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। সুন্নাহ অনুযায়ী এর অনেক উদাহরণ আছে।

আমরা একটি উদাহরণ আলোচনা করছি। মুশরিকদের একটি রীতি ছিলো রাগের মাথায় স্ত্রীকে নিজের মায়ের সাথে তুলনা করে তার সাথে সহবাস না করার কসম খাওয়া। একে যিহার বলা হয়। খাওলা বিনতে সালাবাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) রাসূল ﷺ এর কাছে নালিশ করেন যে, তাঁর স্বামী তাঁর সাথে যিহার করেছেন। এর ভিত্তিতে কুরআনের নিম্নোক্ত ও তার পরবর্তী আয়াতসমূহ নাযিল হয়, যাতে এই অবিচারমূলক প্রথা বিলুপ্ত করা হয়,

যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহ্‌র দরবারে, আল্লাহ্‌ তার কথা শুনেছেন। আল্লাহ্‌ আপনাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনেন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেন। [সূরাহ আল-মুজাদালাহ (৫৮): ১]

খানসা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) এর বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। তাঁর পিতা তাঁকে তাঁর অসম্মতিতে বিয়ে দেন, তাই রাসূল ﷺ তাঁর বিয়ে ভেঙে দেন।

আরেকবার আইশাহর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) কাছে একজন যুবতী অভিযোগ করেন,

“আমার পিতা আমাকে তাঁর ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দেন তাঁর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু আমি এটা ঘৃণা করি।” রাসূল ﷺ তাঁর এই অভিযোগ শুনে তাঁকে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সুযোগ দেন। তিনি বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ ﷺ! আমার পিতা যা করেছেন, আমি তা গ্রহণ করেছি। যা-ই হোক, আমি কেবল জানতে চেয়েছিলাম যে নারীদেরও এই বিষয়ে পছন্দের সুযোগ আছে।”

বুরাইরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) এবং তাঁর স্বামী মুগীস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর একটি ঘটনা। তাঁরা উভয়ই ছিলেন দাস। বুরাইরাহ মুক্তি পান। তাঁর স্বামী তখনো দাস ছিলেন। এখন বুরাইরাহর অধিকার আছে তাঁর স্বামীর সাথে থাকার অথবা তাঁকে ত্যাগ করার। তিনি তাঁকে ত্যাগ করেন এবং মুগীস তাঁর পিছে কাঁদতে কাঁদতে আসলেন, যাতে তিনি মুগীসের কাছে ফিরে আসেন। রাসূল ﷺ বুরাইরাহকে বলেন,

যদি তুমি তার কাছে ফিরে যেতে!

বুরাইরাহ জিজ্ঞেস করেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ! আপনি কি আমাকে এমনটাই করার আদেশ করছেন?” তিনি ﷺ উত্তর দেন,

না। আমি কেবল তার পক্ষে সুপারিশ করছি।

তিনি উত্তর দেন, “তাহলে আমার তাঁকে দরকার নেই।”

আরেকবার একজন মহিলা রাসূল ﷺ এর কাছে আসলেন এই অভিযোগ নিয়ে যে, পুরুষদের জন্য জিহাদ, জামা’আতে সালাত ও অন্যান্য ইবাদাতের সুযোগ আছে, যা নারীদের নেই। রাসূল ﷺ তাঁর এই প্রশ্নে এবং প্রশ্নের ধরনে খুব খুশি হয়েছিলেন।

উমার বিন খাত্তাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) খিলাফাতকালে তিনি মোহরের সর্বোচ্চ পরিমাণের ব্যাপারে একটি আইন জারি করতে উদ্যত হলেন। এক নারী সামনাসামনিই এর প্রতিবাদ করেন। এতে উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) সবার সামনে বলেছিলেন,

উমার ভুল এবং এই মহিলা ঠিক।

রাষ্ট্রপ্রধানের সামনেই আমরা নারীদের মত প্রকাশের অধিকারের এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেখতে পারবো, আর তাদের স্বামীর ব্যাপারে তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

নারীর অভিভাবক ও রক্ষক হিসেবে পুরুষের অবস্থানকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে, আশা করি এই আলোচনা থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে।

লেখক: সালমান ইবনু ফাহদ আল-‘আওদাহ (আল্লাহ্ তাঁর মুক্তি তরান্বিত করুন)

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)