পাথরঘাটায় ১০ বছরে আড়াইশো জেলের মৃত্যু, নিখোঁজ ৫’শ

কাজী রাকিব
কাজী রাকিব, নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৪৯ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

পাথরঘাটায় ১০ বছরে আড়াইশো জেলের মৃত্যু, নিখোঁজ ৫’শউপকূলীয় বরগুনার পাথরঘাটায় সমুদ্র তীরবর্তী দরিদ্র এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা মৎস্য শিকার। আর মৎস্য শিকারে যাওয়া এসব জেলেদের পোহাতে হয় দুর্যোগের নিষ্ঠুর অত্যাচার। গত ১০ বছরে আড়াইশো জেলের সলিল সমাধি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে। এদের মধ্যে নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে পাঁচ শতাধিকেরও বেশি জেলে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশি জেলেদের অভাব রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের। মান্ধাতার আমল থেকে এখনও তারা গভীর সমুদ্রে মাছের অবস্থান নির্ণয় করেন পানি রং ও স্রোত দেখে। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ায় তাদের নেই জীবন রক্ষাকারী পর্যাপ্ত সরঞ্জামও। বৈরী আবহাওয়া উত্তাল সমুদ্র সঠিক সময়ে আবহাওয়া সংকেত না পাওয়া এ সকল দুর্ঘটনার মূল কারণ। জেলেরা জানান, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও জীবিকা অর্জনের ঝুঁকি নিয়ে এ পেশায় কাজ করছেন তারা। সামুদ্রিক ঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিখোঁজ হওয়া মানুষের কোনো সন্ধানই পাননা স্বজনরা। নিখোঁজদের ফিরে আসার অপেক্ষায় কাটান বছরের পর বছর। দারিদ্র্যতার ঘানি টানতে থাকা এসব মানুষ নিজেরাও জানেন না কে কোথায় হারিয়ে যাবেন আগামী দুর্যোগে। নিজেই কি পারবেন বেঁচে থাকতে? আর দুর্গম জায়গা হওয়ার কারণে কোনো প্রকার সহায়তা কিংবা প্রশিক্ষণ পাননা এ এলাকার জেলেরা।

পাথরঘাটার জেলে পল্লী পদ্মা গ্রামের কালু মাঝি, আবুল কালাম, রহিম খাঁ জানান, এখন আর আগের মতো মাছ নেই। আগে যেখানে দুই তিন ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে গিয়ে মাছ ধরতাম। এখন সেই মাছ ধরতে নেটওয়ার্কের বাহিরে ১৮-২০ ঘণ্টা চালিয়ে গিয়ে সাগরের গভীরে যেতে হয়। এতে উপকূলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারায় মাঝিমাল্লাদের জীবনের ঝুঁকিও রয়েছে বেশি। কুলে ভালো আবহাওয়া দেখে সাগরে যাওয়ার দু-তিন দিন পর দেখি আবহাওয়া খারাপ। এ পরিস্থিতিতে কুলে আসতে পথেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

জেলেদের কথা অনুযায়ী এর বাস্তবতাও ঘটেছে। ঘূর্ণিঝড় ‘গুলাব’-এর প্রভাবে সাগর থেকে কুলে আসার পথে চারটি ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় চার জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে গত দু’দিনে। বুধবার সকাল নয়টার দিকে ডুবে যাওয়া ট্রলারের ভেতর থেকে তিনজনের লাশ ও এর আগে মঙ্গলবার ট্রলার মালিক রুহুল আমিন খানের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরা হলো চরদুয়ানি ইউনিয়নের ট্রলার মালিক রুহুল আমিন খান, উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিনঘাটা গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে ইব্রাহিম (৩৫), তোতা মিয়ার ছেলে মনির, আব্দুল কুদ্দুস ফরাজীর ছেলে গোলাম সরোয়ার।ঘূর্ণিঝড়ে ডুবে যাওয়া চারটি ট্রলারের ৪৫ জন মাঝি-মাল্লাকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও আরো দুটি ট্রলারসহ ২৬ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারের মালিক সমিতি ও কোস্টগার্ড চেষ্টা চালাচ্ছে। মৃত্যু জেলেদেরকে পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ।

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, শুধু পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন থেকে গত দশ বছরে প্রায় দেড়শ মাঝিমাল্লার মৃত্যু হয়েছে ট্রলার ডুবিতে। নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে তিন শতাধিক জেলে।

মৎস্যজীবি টলার মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আবুল হোসেন ফরাজী জানান এভাবে প্রতি বছরই জেলেদের লাশের সংখ্যা সারি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার থেকে কোন ধরনের সহায়তা পাচ্ছে না এসকল পরিবারগুলো।

তিনি আরো জানান, বরগুনা জেলার নিবন্ধিত ৪৪ হাজার জেলের মধ্যে কারো জীবন বীমা নেই। সে কারণে সরকারের পাশাপাশি কোনো এনজিও থেকে ও সহয়তা পাচ্ছে না জেলেরা।

জেলা মৎস্যজীবি ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, দেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় রয়েছে ব্যাপক মৎস্য সম্পদ। কিন্তু সেটা আহরণে নেই জেলেদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তিনি মনে করেন সরকারিভাবে যদি ভর্তুকি দিয়ে মাছ ধরার আধুনিক সরঞ্জাম জেলেদের দেয়া হলে সমুদ্র থেকে কয়েকগুণ মাছ আহরণ বাড়বে। এতে করে সরকারের রাজস্ব বাড়বে কয়েক কোটি টাকা। পাশাপাশি কমে আসবে জেলেদের প্রাণহানির সংখ্যা।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)