পাথরঘাটায় আগুনে দগ্ধ মায়ের জন্য মন কাঁদেনি ছেলের, দায়িত্ব নিলেন চিকিৎসক

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ০৫:৩৪ পিএম, ১৯ মে ২০২১

পাথরঘাটায় আগুনে দগ্ধ মায়ের জন্য মন কাঁদেনি ছেলের, দায়িত্ব নিলেন চিকিৎসক

চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকায় রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের। জনবল সংকট থাকায় নির্ধারিত সময়ের চেয়েও অতিরিক্ত সময় জরুরী বিভাগে মাত্র একজন চিকিৎসক দিয়েই সামাল দিতে হয়। এর মধ্যে এক সঙ্গে কয়েকজন রোগী আসলে জরুরী বিভাগে জটলা বেঁধে যায়। এ দৃশ্য প্রতিদিনের।

এরমধ্যে মঙ্গলবার রাতে পৌনে বারোটার দিকে কুপির আগুনে দগ্ধ হয়ে উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের কুপধন গ্রাম থেকে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭০ বছরে বৃদ্ধ স্বামী কুদ্দুস মিয়ার সহযোগিতায় চিকিৎসা নিতে আসেন ৬০ বছরের বৃদ্ধা মমতাজ বেগম।

তখন চালের পোকা দমনের ট্যাবলেট ও কিটনাশক খেয়ে আসা দুটি রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক জিএম আকবর।

৫০% ডিপ বার্ন নিয়ে আসা বৃদ্ধার শরীরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসক নিজে দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। এনিয়ে পরের দিন সকালে তার‌ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

“রাত ১১.৪০
মাত্র চালের পোকা মারার বিষ খেয়ে আসা একটি রোগী ম্যানেজ করে আরেকটি বিষ খাওয়া রোগী ম্যানেজ করবো, ঠিক তখনই এক রিকশাচালক এসে বলল স্যার আরেকটা পোড়া রুগী আসতেছে।
আমি একটু হতাশ হয়ে হাসপাতালের গেটের দিকে তাকালাম, দেখলাম অন্ধকারে আবছা আলোয় ৭০ বছরের উপর এক বৃদ্ধ ৬০ বছরের বৃদ্ধাকে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে ইমারজেন্সির দিকে আসছে। সামনে আসতেই দেখি বৃদ্ধার ৫০% এর মতো ডিপ বার্ন। দেখেই বুকটা ছেদ করে উঠলো। জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে হয়েছে, বললো কুপির আগুন লেগেছিল। আমি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার সাথে কে এসেছে? বৃদ্ধ কোন জবাব দিল না।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম বাবা আপনার সাথে কে এসেছে? ঔষধ পত্র কে আনবে? সে জবাব দিল আমিই আনমু, আমি বললাম কেন আপনার ছেলে মেয়ে নেই? জবাবে তিনি বললেন আছে। আমি বল্লাম তাহলে আসেনি কেন? তিনি বললেন মোবাইল দিছি ওরা বলছে আসতে পারবো না। শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম। আমি তাকে বল্লাম আপনার রোগীকে বরিশাল মেডিকেল নিতে হবে। তিনি বললেন আমার কাছে ২০০ টাকা আছে কিভাবে নিবো? এদিকে রোগী অনেকটা ডিহাইড্রেট হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারলাম আর সময় নষ্ট করা যাবে না। আমি নিজে সামনের ঔষধের দোকান থেকে নরমাল স্যালইন এবং ড্রেসিং এর জিনিস কিনতে গেলাম। কিন্তু নর্মাল স্যালইন পাচ্ছিলাম না, এতো রাতে সব দোকান ও খোলা না,তার পরে এক ক্লিনিক থেকে ধার করে নরমাল স্যালাইন মেনেজ করে নিয়ে আসলাম।
সহযোগী নজরুল ভাইকে বললাম ড্রেসিং করতে।
এরপর একটা বুদ্ধি আটলাম তার ছেলেদের ফোন করে আনি। বৃদ্ধ চাচাকে বললাম আপনার ছেলের নাম্বার আছে, তিনি তার বড় ছেলে হাসানের নাম্বার দিলো, আমি ফোন দিলাম, ফোনে রিং হবার সাথে সাথেই সে ফোন কেটে দিল, আমি আবার ফোন দিয়ে দেখলাম ফোন বন্ধ করে রাখছে , এর পর তার ছোট ছেলের নাম্বার নিলাম এবং ফোন করলাম, ফোনে কয়েকটা রিং বাজতেই অপার থেকে রিসিভ হলো, আমি বললাম আমি পাথরঘাটা থানা থেকে বলছি, তোমার মা সারা শরীর পোড়ে হাসপাতালে আছেন ৫ মিনিটের মধ্যে পাথরঘাটার হাসপাতালে আসো। আমি জানি আমি মিথ্যা বলে অন্যায় কাজ করেছি,‌ কিন্তু আমি যদি বলতাম আমি অমুক ডাক্তার তোমার মা অসুস্থ হাসপাতালে আসো! আমি নিশ্চিত আমাকে বকা দিয়ে ফোন রেখে দিত। ২০ মিনিট চলে গেলো ওরা কেও আসলোনা। তখন হাসপাতালের সামনে প্রায় ৩০-৪০ জন লোক। তারা বললো স্যার আরেকটা ফোন দেন এবং এবার রাগিভাবে বকা দেন, আমি তাই করলাম যাতে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি আসে। ১০ মিনিট পর তার ছোট ছেলে আসলো। আমি বললাম তোমার বড় ভাই কই? সে বললো ও আসবে না।‌ ঐদিক থেকে এক লোক বললো স্যার অর বড় ভাই এর টাকা আছে আজও ১০০০০ টাকা আমার কাছে রাখছে। আমি বৃদ্ধর ছোট ছেলেকে সব বললাম,ও বললো স্যার আমার কাছে কোন টাকা নেই, আমি বুঝালাম নাই বললে তো হবেনা। মা কে বাচাতে হলে মেনেজ করতে হবে।ঐ দিকে এক লোক তার বড় ভাবিকে ফোন দেয় এবং আমার কাছে ধরায় দেয়, আমি বললাম আমি থানা থেকে বলছি তোমার মা হাসপাতালে তারাতাড়ি আসো। সে জবাবে আমায় বললো আপনি যেই হন আমি যামু না। তাদের (মা-বাবার) সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। আমি ধমক দিয়ে বললাম তুই আসবি নাকি পুলিশ পাঠবো। সে বলে যারে খুশি পাঠান। আমি থানায় ফোন করে ঘটনাটি জানাই, ডিউটি অফিসার আমায় সম্মানের সহিত বললেন স্যার আমি ৩ জন পুলিশ পাঠাচ্ছি। পুলিশ সদস্যরা আসলেন আমি ঘটনাটি বললাম তারা বললেন স্যার আমরা ধরে নিয়ে আসতেছি। বড় ছেলে কে নিয়ে আসা হলো রাত দুইটার দিকে। আমি তাকে অনেক বুঝালাম কিন্তু সে কিছুতেই তার মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে রাজি হলো না। আমি অনেক ভাবে বুঝালাম তারপর বললাম যাও উপরে গিয়ে তোমার মা কে একবার দেখ। তার ছোট ভাইকেও তার সাথে যেতে বললাম। এই দিকে এস আই সাহেব আমায় বললেন স্যার আপনি যার মাকে বাঁচাতে এত কিছু করলেন সে কি করতে ছিল জানেন? আমি বললাম কি করতেছিল। তিনি বললেন আপনার নামে সাংবাদিক এক জনের কাছে বলতে ছিল আপনি নাকি পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাকে ধমকাইছেন। আমি শুনে হেসে দিয়ে বললাম, আপনাকে ধন্যবাদ কষ্টকরে আসার জন্য। তিনি হাসি দিয়ে বললেন স্যার ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। আমি বললাম যে সমাজে বাস করি সেখানে প্রাপ্য যারা তারা কিছু পায় না।রাত ৩ টা উপর থেকে সিস্টার ফোন দিয়ে বল্লো স্যার পোড়া রুগী টা ভালো না রেফার করে দেন।আমি বললাম ফাইলসহ তাদের ছেলেদের আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। তারা আসলো অনেক কষ্ট করে বুঝালাম, তাদের বউদের সামনে বললাম তোমরাও একদিন বুড়া হবা। আজ বাবা মার সাথে যা করবে তোমার ও তার ফল পাবা। আমার কথা শুনে দেখলাম ছোট ছেলের চোখের কোনায় এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। অবশেষে তারা সকালে তাদের মা কে বরিশাল নিতে রাজি হলো। এরপর ও আমার চোখে আজ ঘূম নেই। যে মা পৃথিবীর আলো দেখালো তাকে কি করে এত অবহেলা সম্ভব?……পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।”

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)