পানির দেশেই নেই খাওয়ার পানি

ডেস্ক নিউজ
ডেস্ক নিউজ,
প্রকাশিত: ১১:১৯ এএম, ২২ মার্চ ২০১৮

---
সুমন সিকদার (বরগুনা): চারিদিকে নদ-নদী বেষ্টিত উপকূলীয় জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। এই উপজেলার চারপাশে অফুরন্ত পানির উৎস থাকলেও রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সুপেয় পানির অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ উপজেলার জনজীবন। পানি সমস্যা নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগীতায় পাঁচ শতাধিক পণ্ড-স্যান্ড ফিল্টার (পিএসফ) বসানো হলেও তার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ডায়রিয়া প্রবণ এ জেলাটির জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে রয়েছে।

বরগুনা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী, পাথরঘাটা সদর, চরদুয়ানী, নাচনাপাড়া ইউনিয়নে ভূপ্রাকৃতিক কারণে গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না। এই চার ইউনিয়নের জন্য বিকল্প পানির উৎস হিসেবে ৫৮৯টি পুকুরে বালুর ফিল্টার (পিএসএফ) বসানো হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে সচল আছে মাত্র ১৩১টি এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা দেওয়া আরো ২৫টি ফিল্টার সচল আছে। বাকি সকল ফিল্টার গুলো একদম পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। এছাড়াও এ উপজেলায় পানি সমস্যা নিরসনে ২৯৪টি অগভীর এবং ২ হাজার ১২৩টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। যার অধিকাংশই বর্তমানে নষ্ট হয়ে গেছে।

স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপ থেকে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে গভীর নলকূপ থেকে ওঠে লোনা পানি। তাই বাধ্য হয়ে পানির চাহিদা পূরণে ব্যবহার করতে হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ডোবা নালার পানি। এতে করে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা।

উপজেলার রুহিতা গ্রামের গৃহবধূ কোহিনূর বেগম প্রতিদিন ঠাঠা রোদের মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে পাশের গ্রাম কোড়ালিয়া যান পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে। পানির লাইন দীর্ঘ হওয়ায় এক কলসি পানি সংগ্রহ করতে তার চলে যায় একবেলা। পাঁচজনের সংসারে খাবার পানির প্রয়োজন মেটাতে শুধু এ বেলায়ই নয় আসতে হবে আরেকবার। প্রতিদিন এভাবেই সুপেয় পানির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তারা।

কোহিনুর বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন এভাবে পানি সংগ্রহ করতে দিনের অর্ধেকটা সময় চলে যায়। তারপর ঘর গেরস্থলির কাজ তো আছেই। এভাবে কতোকাল যে পানির লইগ্গা মোগো সংগ্রাম করা লাগবে কইতে পারি না।’

শুধু কোহিনুর বেগমই নয় পাথরঘাটার গোটা উপজেলা জুড়ে রয়েছে এই একই সমস্যা। কেউ পুকুরের পানি দিয়ে সারছেন ঘর গেরস্থলির কাজ। আবার কেউ পুকুরের পানি ফুটিয়েই ব্যবস্থা করছেন খাবার পানির।

উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের গৃহবধূ নাজমা বেগম ঘরের পাশের ডোবার পানি দিয়েই খাওয়া ও দৈনন্দিন কাজ সারেন।

তিনি বলেন, ‘একটা ফিল্টার দিছিলো মোগো হ্যা এহন অচল। একমাসো ঠিকমতো পানি ওঠে নায় হেরপর থেকেই আর কাজ করে না। এই ফিল্টার দিয়ে মোগো কি হইবে?’

এখানে কথা হয় একই গ্রামের আবদুস সালামের সাথে ৫ কি.মি. পথ হেটে পানি নিতে এসছেন তিনি। বাড়ির পাশে একটি পিএসএফ থাকলেও তা এখন পুরোপুরি নষ্ট। তাই এখানেই পানি নিতে এসছেন তিনি। প্রতিদিন এখানে আসা সম্ভব হয় না তার। তাই মাঝে মধ্যে পুকুর ও ডোবা নালা থেকে পানি উত্তোলন করে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি খেতেও হয়।

আবদুস সালাম বলেন, ‘পুকুর ও ডোবার পানি খাওয়ায় অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। পানির মধ্যে থাইক্কাও মোরা খাওয়ার পানি পাই না।’

ফিল্টার নষ্ট থাকায় পুকুর, ডোবানালা ও খাল বিলের পানি খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করায় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. হুমায়ন বলেন, পাথরঘাটায় নিরাপদ পানির তীব্র অভার রয়েছে। এতে করে এই সকল এলাকায় খাল-বিল নদী নালার পানি পান করায় টাইফয়েড, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার মানুষ। এতে করে এই এলাকার জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে রয়েছে। তাই দ্রুত এই সকল অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ পানি ব্যবস্থা করতে হবে।

অন্যদিকে পৌর এলাকায়ও একই সমস্যা। তাই ডানিডার সহযোগিতায় পৌর এলাকা থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে কাকচিড়া ইউনিয়নে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে মাত্র ৬৫০টি হোল্ডিংয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

সুপেয় পানির জন্য বরগুনাসহ উপকূলীয় লবনাক্ত এলাকায় কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এর কোন পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও উন্নয়ন কর্মীদের দাবী এসকল টাকা শুধু মাত্র ঠিকাদারদের পকেট ভারী করার জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে। বস্তুত সুপেয় পানির অভাব রয়েই গেছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন সেবা এর প্রধান নির্বাহী আরিফ মোল্লা বলেন, বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে কাজ করছেন জিও এবং এনজিও এবং এই সব প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে আর কোনো তদারকি থাকে না। তাই প্রয়োজন দীর্ঘ স্থায়ী পরিকল্প না। দীর্ঘ মেয়াদে পানি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।

পাথরঘাটাসহ বরগুনার বিভিন্ন স্থানে পণ্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) বসানে হয়েছিলো তা কারিগরি কাঠামো ঠিক না হওয়ায় খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে স্বীকার করলেন বরগুনা জনস্বাস্থ্য বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মাহমুদ খান।

তবে এই এলাকায় সুপেয় পানির চাহিদা পুড়নে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলেও জানালেন তিনি।

এন এ এস / পাথরঘাটা নিউজ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)