সুপেয় পানির তীব্র সংকট উপকূলীয় পাথরঘাটায়, পানি বাহিত রোগে ঠাঁই নেই হাসপাতালে

কাজী রাকিব
কাজী রাকিব, নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:২৯ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০২১

সুপেয় পানির তীব্র সংকট উপকূলীয় পাথরঘাটায়, পানি বাহিত রোগে ঠাঁই নেই হাসপাতালে

চারিদিকে নদ-নদী বেষ্টিত উপকূলীয় জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। এই উপজেলার চারপাশে অফুরন্ত পানির উৎস থাকলেও রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সুপেয় পানির অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের জনজীবন। পানি সমস্যা নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগীতায় পাঁচ শতাধিক পণ্ড-স্যান্ড ফিল্টার (পিএসফ) বসানো হলেও তার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ডায়রিয়া প্রবণ এ উপজেলাটির জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে রয়েছে। প্রতিদিন শতাধিক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হওয়ায় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসকরা।

দ্রুত এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ পানি ব্যবস্থা নিশ্চিত না করতে পারলে জনজীবন বিপর্যস্ত হবে বলেও মনে করেন চিকিৎসকরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান পানি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। কিছু কিছু কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু আম্পানসহ ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকাগুলোতে প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে পানযোগ্য পানি থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে বরগুনার পাথরঘাটার স্থান অন্যতম। আন্তর্জাতিকভাবে পানিতে লবণের মাত্রা ৬’শ পিপিএম পর্যন্ত খাবার উপযোগী ধরা হয়। কিন্তু পাথরঘাটার ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের মাত্রা তিনহাজার পিপিএম। যা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক’শ গুণ বেশি।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ উপজেলার পৌরসভাসহ ৮ টি ইউনিয়নের মধ্যে কাঠালতলী, কালমেঘা পাথরঘাটা সদর, চরদুয়ানী, নাচনাপাড়া ইউনিয়নে ভূপ্রাকৃতিক কারণে গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না। এই সকল ইউনিয়নের জন্য বিকল্প পানির উৎস হিসেবে ৫৮৯ টি পুকুরে বালুর ফিল্টার (পিএসএফ) বসানো হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে সচল আছে মাত্র ৯৬ টি। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা দেওয়া আরো ২০ টির মত ফিল্টার সচল আছে। বাকি সকল ফিল্টার গুলো একদম পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। এছাড়াও এ উপজেলায় পানি সমস্যা নিরসনে ৯০৩ টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও এর মধ্যে ৮২৮ টি অকেজ। এছাড়া গভীর নলকূপ স্থাপন না করতে পারায় বিকল্প হিসেবে রেইন ওয়াটার হারবেস্টিন (বৃষ্টির পানি সরবরাহ) ৩০২ স্থাপন করা হয়েছে। তবে চলতি বছরে বৃষ্টি না হওয়ায় ওয়াটার হারবেস্টিন কোনো উপকারে আসছেনা বলে জানান উপ-সহকারী প্রকৌশলী দোলা মল্লিক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় পাথরঘাটায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ৬ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দে ৪৪ পুকুর খনন ও সংস্কারের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ টি পুকুর সেচ করে কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এ কারনে গ্রামাঞ্চলের লোকজন ডোবা নালার পানি খাচ্ছে। অপরদিকে এসব অঞ্চলের ডোবা নালায় নদীর লবনাক্ত পানি প্রবেশ করায় পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপ থেকে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে গভীর নলকূপ থেকে ওঠে লোনা পানি। তাই বাধ্য হয়ে পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হয় তাদের। কিন্তু এবছর একই যোগে সারা উপজেলার খাস পুকুরগুলো খনন করার কারণে পানির চাহিদা পূরণে ব্যবহার করতে হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ডোবা নালার পানি। এতে করে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা। চলতি বছরের বৃষ্টি না হওয়াতেও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।

পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা কালমেঘা ইউনিয়নের ছগির হোসেন জানান, তাদের একই বাড়ি থেকে আটজন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। গত চারদিন ধরে পাতলা পায়খানা ও বমি হচ্ছিল তাদের। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হওয়ায় তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।

পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স তানিয়া খাতুন জানান, শতকরা ৭০ শতাংশ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে এখানে। প্রতি বেডে দু’জন করে রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক নার্স দিয়ে এ রোগীদের সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।

এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা ডা. আবুল ফাত্তাহ জানান, পাথরঘাটায় নিরাপদ পানির তীব্র অভাব রয়েছে। এতে করে এই সকল এলাকায় খাল-বিল নদী নালার পানি পান করায় টাইফয়েড, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার মানুষ। চলতি মাসে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় দেড় হাজারের অধিক ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। গত সপ্তাহে রোগীর চাপ বেশী হওয়ায় অনেককেই জায়গা দিতে পারা যায়নি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে এখানে। তাই বারান্দা ও করিডরে তাদের চিকিৎসা দিতে হয়েছে। এতে করে এই এলাকার জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে রয়েছে।

অপরদিকে চিকিৎসক ও নার্স সংকট থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কষ্টসাধ্য হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)