গণমাধ্যম কি আসলেই মুক্ত?

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৭:৪২ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ | আপডেট: ০৭:৪৩ এএম, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

---৩ মে এলেই আমরা ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার তাড়না অনুভব করি। কারণ মে মাসের এ দিনটি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস, কিন্তু যে প্রশ্নটি বরাবরই সামনে আসে তা হলো, এই ফ্রিডম বা স্বাধীনতা কার? গণমাধ্যমের, গণমাধ্যমকর্মীর না গণমাধ্যম মালিকের?

আদর্শিক অবস্থায় গণমাধ্যমকর্মীর স্বাধীনতা থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। আরো পরিষ্কার করে বললে, সংবাদকে বস্তুনিষ্ঠ ও অবিকৃতরূপে, কোনোরকম ভয়-ভীতি ছাড়া প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল, এটি আসলে গণমাধ্যম মালিকের স্বাধীনতা। যদিও করপোরেট পুঁজির দাপটে মালিকের স্বাধীনতাও এখন নিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞাপনদাতাদের দ্বারা। সুতরাং যখন মালিক-সাংবাদিক কেউই স্বাধীন নন, তখন প্রেস ফ্রিডম আসলে কী কাজে লাগবে সেই প্রশ্ন তোলা সঙ্গতই।

২.
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলেই আমরা এই স্বাধীনতাকে গণমাধ্যমকর্মী বা সাংবাদিকের ওপর শারীরিক আক্রমণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পছন্দ করি এবং গত এক দশকে বা এক বছরে দেশে-বিদেশে কত সংখ্যক সাংবাদিক নিহত বা আহত হয়েছেন, মামলার শিকার হয়েছেন ইত্যাদির পরিসংখ্যান তুলে ধরি। যদিও অনেক সময়ই দেখা যায়, এসব হামলা মামলার কারণ ব্যক্তিগত। সরাসরি সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

কিন্তু প্রেস ফ্রিডমের মানে যে আরো ব্যাপক, তা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। বিশেষ করে সাংবাদিকের কর্মের নিশ্চয়তা বা জব সিকিউরিটি, তার বেতন কাঠামো বা ওয়েজবোর্ড ইত্যাদি নিয়ে সাংবাদিক নেতারাও বেশি কথা বলতে আগ্রহী নন। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর সংবাদপত্রে ওয়েজবোর্ড চালু হলেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তা মানে। এখনো কোনো টেলিভিশনে ওয়েজবোর্ড চালু হয়নি। প্রতিটি টেলিভিশন তাদের নিজস্ব কাঠামোতে চলে।

৩.
শত শত অনলাইন সংবাদপত্র চালু হয়েছে। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটির নাম পাঠকরা জানে। বাকিগুলো ফেসবুকসর্বস্ব। অনেকে যা খুশি নামের সঙ্গে ডটকম বসিয়ে দিয়ে অনলাইন পত্রিকা খুলে ফেলছেন। গাড়িতে ‘প্রেস’ লেখা স্টিকার লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাংবাদিকতার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকলেও এসব ডটকমের ‘সাংবাদিকরা’ নানা জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রেস ফ্রিডম ডেতে এই বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ এসব ব্যাঙের ছাতা অনলাইন সংবাদপত্রগুলো আর কিছু না পারুক, ভুলভালো আর মিথ্যা খবর পরিবেশন করে ফেসবুকের বহু মানুষকে প্রতিনিয়তই বোকা বানাচ্ছে। সরকার অনলাইন সংবাদপত্রগুলোকে নিবন্ধিত করা এবং নীতিমালার আওতায় আনার কথা বললেও কাজের কাজ আসলে কী হচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।

৪.
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে হালের তরুণদের একটা বড় টার্গেট টিভি সাংবাদিক হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েই বা ছাত্র অবস্থাতেই অনেকে তারকা হয়ে যান। অথচ দেখা যায়, তথাকথিত র‌য়্যাল বিষয়ে ভালো ফলাফলকারী এদের অনেকেরই সাংবাদিকতার ন্যূনতম জ্ঞানটুকু নেই। বাংলায় যা লেখেন, অনেক সময় তার অর্থ হয়তো তাঁরা নিজেরাও বোঝেন না। সুতরাং প্রেস ফ্রিডম মানে শুধু মুক্তভাবে সাংবাদিকতা করা নয়; বরং আপনি পাঠক-দর্শককে কী দিচ্ছেন, সেটি কতটা মানসম্মত, সেটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং কতটা তথ্যনির্ভর-সেটিও আলোচনায় থাকতে হবে।

৫.
গণমাধ্যমে এখন প্রচুর নারীকর্মী কাজ করেন। নারীদের ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান থাকলেও কয়টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এই ছুটি দেয় এবং বিবাহিত বা ছোট সন্তান আছে জানার পর কয়টি প্রতিষ্ঠান ওই নারীকে চাকরি দিতে উৎসাহ বোধ করে-সেটি নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। কয়টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ নারীবান্ধব- সেটি নিয়েও কথা বলতে হবে যদি আপনি সত্যি সত্যি প্রেস ফ্রিডম নিয়ে কথা বলতে চান।

৬.
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা তাহলে এই বস্তুনিষ্ঠতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করাও এখন জরুরি। কেননা আপনি যেটিকে বস্তুনিষ্ঠ বলছেন, সরকার বা সরকারি দলের নেতারা সেটিকে ‘নাশকতায় উসকানি’ বলে অভিহিত করতে পারে। আদালতের কোনো রায় বা সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্তব্যের কারণে অনেকের উপরেও আদালত অবমাননার খড়গ নেমে এসেছে। সুতরাং আদালত অবমাননার পরিষ্কার সংজ্ঞা এবং সাংবাদিকরা আদালত ইস্যুতে ঠিক কতটুকু লিখতে পারবেন, তারও একটি পরিষ্কার নির্দেশনা থাকা দরকার।

৭.
বছর পাঁচ-সাত বছর আগেও এই দিবসে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যে পরিমাণ সভা-সেমিনার ও আলোচনা হতো; মুক্ত সাংবাদিকতা আদতে না থাকলেও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে ধরনের আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হতো, এখন সেটির সংখ্যা অনেক কমে গেছে বলে মনে হয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন এ রকম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্তা-ব্যক্তি বললেন, ‘এখন বড় এনজিওওয়ালারাও এ বিষয় নিয়ে সভা-সেমিনারে খুব বেশি আগ্রহী নয়’। কারণ কী? দেশের গণমাধ্যম ব্যাপক মাত্রায় স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে এ নিয়ে আর আলোচনার দরকার নেই নাকি এ নিয়ে কথা বলার মতো সাহস নেই, কোনটি?

লেখক : সাংবাদিক

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)