বিশ্বকাপ ফুটবলখেলা ভিনদেশে, মরি-মারি আমরা!

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, ২৭ জুন ২০১৮

খেলা ভিনদেশে, মরি-মারি আমরা!ফুটবল বাঙালির ঐতিহ্য এবং খেলার ইতিহাস বেশ পুরনো। আর এ খেলাটি আমরা বাঙালিরা মনেপ্রাণেই ভালোবাসি এবং লালন করে থাকি। কালের পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশ বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। ফুটবল খেলা নিয়ে আমাদের ঐতিহ্য থাকলেও সারা বিশ্বে পরিচিতি হয়েছে ক্রিকেট দিয়ে। কিন্তু একটি বিষয় আমরা স্পষ্ট, বাঙালিরা আবেগের ওপর বেশি ঝুঁকে থাকে। আর সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবল, ক্রিকেটসহ নানা খেলা নিয়ে। বিশেষ করে ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়ে আমরা বেশি মাতামাতি করে থাকি। আর এই মাতামাতি ও আবেগের মাত্রা কখনো কখনো বেড়ে গিয়ে নির্মম, ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়।

আগেই বলেছি, আমরা বাঙালিরা খুবই আবেগপ্রবণ। কখনো কখনো আবেগতাড়িত হয়ে ঈর্ষান্বিতও হয়ে পড়ি। কখনো কখনো ঈর্ষাকাতর ও অসহনশীল হয়ে পড়ি। কেন অন্যের পছন্দের দলটা জিতলে মানতে পারব না? কেন অন্যের পছন্দের খেলোয়াড়টা ভালো খেললে সহ্য করতে পারব না, কেন সে ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়লে তালিয়া বাজাব? তবে, আমার ব্যক্তিগতভাবে খেলা নিয়ে এত মাথাব্যথা নেই। খেলা চলছে, দেখছি। কিন্তু খেলা দেখলে কোনো একপক্ষের সমর্থক না হলে খেলা দেখে মজা পাওয়া যায় না, সে কারণে খেলার সময় কোনো না কোনো একপক্ষকে সমর্থন দিতেই হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, অন্য দলের সমর্থককে সহ্য করা যাবে না, তার জন্য সহিংসতা করতে হবে। নিজের দল হারলে অনেক কিছু করতে হবে; এটা কেমন কথা? নিজের দেশও না, বিশ্বকাপটা খেলছে অন্য মহাদেশের দুটা দল, খেলা পছন্দ-অপছন্দের জায়গা থেকে তাদের পক্ষে-বিপক্ষে বলতে গিয়ে আমরা নিজেরাই ব্যক্তিত্ব নষ্ট করে ফেলছি। প্রায়ই ফেসবুকে দেখছি, কারো পোস্টে কেউ মনোক্ষুন্ন হয়ে পাল্টা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কেউ এমনই নিম্নরুচির ভাষা ব্যবহার করছেন যে তাকে এত দিন ধরে ভালো জেনে আসা লোকটা বলেই ফেলছেন, আপনি এত রুচিহীন হতে পারেন? কেউ এত দিন ধরে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখা বন্ধুটাকেও বিদায় করে দিচ্ছেন তার এ ধরনের কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে। এমনকি খেলা নিয়ে মারামারি ও আত্মহত্যার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটছে।

বাংলাদেশে ফুটবল খেলার ইতিহাস বেশ পুরনো। এই তো নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ফুটবলই ছিল এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। তারপর ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর সেই জনপ্রিয়তায় বেশ ভাটা পড়েছে। আর এখন তো প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে দেশের ফুটবলের অবস্থা যেমনই হোক, আন্তর্জাতিক ফুটবল কিংবা বিদেশি ক্লাব ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা এ দেশে অফুরান। বিশেষ করে ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই এ দেশের মানুষ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-ইতালি-স্পেন-ফ্রান্স কিংবা জার্মানি, এমন দলগুলোর সমর্থনে বিভক্ত হয়ে পড়েন। রাস্তায় কিংবা বাড়ির ছাদে প্রিয় দলের পতাকা উড়তে দেখা যায়। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচে এসেই বিদায়ের বাঁশি বেজেছে বাংলাদেশ সিংহভাগ সমর্থকদের দল আর্জেন্টিনার। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে হেরে রীতিমতো খাদের কিনারে লিওনেল মেসির দল। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র এবং ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে ‘ডি’ গ্রুপের তলানিতে অবস্থান করছে হোর্হে সাম্পাওলির শিষ্যরা। এক ম্যাচেই যেন সব লজ্জার রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছেন তারা। এখন তাদের শেষ ষোলোয় যাওয়া নির্ভর করছে গ্রুপের অন্য দলগুলোর ওপর। তাই ভাগ্যের ওপরই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার তারকা মিডফিল্ডার হ্যাভিয়ের মাচেরানো। এখন প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।

১৯৫৮ সালের পর অর্থাৎ ৬০ বছর পর গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় পরাজয় এটি, সেবার চেকোস্লেøাভাকিয়ার কাছে ৬-১ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। এ হারে মাত্র একটি পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের তৃতীয় ম্যাচে নামতে হচ্ছে আলবিসেলেস্তেদের। ১৯৮৯ সালের কোপা আমেরিকার পর আর্জেন্টিনা তাদের ফুটবল ইতিহাসে কোনো মেজর টুর্নামেন্টই প্রথম দুই ম্যাচে ১ পয়েন্ট নিয়ে কখনো শুরু করেনি। বিশ্বকাপ ১৯৭৪ সালে সর্বশেষ দুই ম্যাচে এক পয়েন্ট পেয়েছিল তারা। কোস্টারিকার বিপক্ষে শুক্রবার প্রায় ড্র হতে যাওয়া ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ে গোল করে ব্রাজিলের জয়ের পথ সুগম করেছেন। সেন্ট পিটার্সবার্গে নির্ধারিত সময়ে আসেনি গোল। ব্রাজিলের দুই গোল ৯০ মিনিটের পর। মাইকে ঘোষণা এলো, যোগ করা সময় ছয় মিনিট। এরপরই যেন কী হয়ে গেল। ব্রাজিল দলটা যেন গোলাবারুদের মতোই জ্বলে উঠল। কোস্টারিকা নব্বই মিনিট ধরে প্রতিরক্ষা রেখা আগলে রাখলেও শেষ কয়েকটা মুহূর্ত আর পারল না। ব্রাজিল সমর্থকদের আশাপূরণ হলো। যোগ করা সময়ে নেইমার এবং কটিনহোর দুর্দান্ত দুই গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল ব্রাজিল। নকআউট পর্বের পথে এগিয়ে গেল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।

বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং এত সমর্থকদের দল আর্জেন্টিনা হেরে গিয়ে কোটি হৃদয়ে চলছে রক্তক্ষরণ। সীমাহীন বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমর্থকদের আত্মার সেই আকুতির সামান্য আঁচ মিলছে বিশ্ব মিডিয়ায়। রক্ত ঝরার মতোই কষ্ট, শোক আর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে একেকটি শব্দে। ‘লজ্জা, বিপর্যয় এবং যন্ত্রণা’ মেসি ও আর্জেন্টিনাকে এভাবেই তুলে ধরেছে আর্জেন্টিনার মিডিয়া। একইভাবে তুলে ধরেছে স্প্যানিশ মিডিয়াগুলোও, যে দেশটির ক্লাব বার্সেলোনায় খেলেন মেসি। থেমে নেই বিশ্বমিডিয়াও। এক কথায় সব যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছে ক্রীড়াবিষয়ক আর্জেন্টিনার সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা ওলে। তাদের শিরোনাম, ‘সীমাহীন যন্ত্রণা’। ‘বিধ্বস্ত জাতীয় দল, সঙ্গে একটি ছন্নছাড়া ম্যানেজমেন্ট এবং প্রত্যয়হীন খেলোয়াড়, সব ম্যাসাকার’ ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে আর্জেন্টিনার হারটাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছে পত্রিকাটি। তারা আরো লিখেছে, ‘মেসি কিছুই করতে পারেননি, তিনি কখনোই আলো ছড়াতে পারেননি এবং এখন আমাদের অলৌকিক কিছু করতে হবে।’ লস অ্যান্ডেস তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছে, ‘ব্যর্থ সাম্পাওলি এবং মেসি ছিলেন নিজের ছায়া।’ আর্জেন্টাইন দৈনিক ‘ইউএনও’ পুরো পাতায় কোচ সাম্পাওলির ছবি দিয়ে শিরোনাম করেছন ‘পরাজয়ের জনক!’ এল দায়া পত্রিকার শিরোনাম, ‘লজ্জা : খেলা ছাড়া, আত্মা ছাড়া আর্জেন্টিনা এখন অতল গহ্বরে।’ দেশটির ‘লা নাচিওন’ শিরোনাম করেছে, আর্জেন্টিনাকে হতাশায় ডুবিয়েছে ক্রোয়েশিয়া এবং তাদের বিশ্বকাপে ভবিষ্যৎই এখন সন্দেহের মধ্যে। আর ক্লারিন পত্রিকার শিরোনাম ছিল আরো ঝাঁজালো, ‘ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে বিপর্যয় : আর্জেন্টিনা হতাশ এবং বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার শেষ প্রান্তে।’

যাক মূল কথা হলো, খেলা একটি আনন্দের বিষয়। এ খেলায় সমর্থন যেমন থাকবে, তেমনি পক্ষ-বিপক্ষও থাকে। বাংলাদেশেও ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ নানা খেলাধুলা রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, বাংলাদেশের খেলার চেয়ে দেশের বাইরের রাষ্ট্রের খেলার প্রতি অধিকাংশ বাঙালি মগ্ন থাকে। আবেগতাড়িত হয়ে নিজের দলের পতাকা তৈরি, গালে ও বুকে-পিঠে পছন্দের রাষ্ট্রের পতাকা স্টিকারসংবলিত ছবি অঙ্কন করে সমর্থন জানান দিচ্ছে। বাংলাদেশেই অনেকাংশে দেখা গেছে খেলা হচ্ছে ভিনদেশে, কিন্তু মারামারি, হানাহানি, ধ্বংসাত্মক হচ্ছে আমাদের দেশে। এটি সত্যিকার অর্থে ঠিক নয়; সমর্থন থাকতে পারে, সেটি অন্যায় নয়? কখনো দেখা গেছে, পছন্দের দলকে সমর্থন দিতে গিয়ে ওই রাষ্ট্রের পতাকা তৈরি করে টানানো হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অবমূল্যায়ন করাও হচ্ছে। কিন্তু পছন্দের দল হেরে গেলে বা বিপক্ষের দল জিতলে ধ্বংসাত্মক এটিও কামনা নয়। প্রতি বছর বিশ্বকাপ খেলায় সমর্থকদের মধ্যে মারামারি কমবেশি হতে দেখা গেছে। এ বছর খুলনা মহানগরীর দৌলতপুরে দুই আর্জেন্টিনা সমর্থককে কুপিয়ে জখম করেছেন ব্রাজিল সমর্থকরা। নিজের দল হেরে যাওয়ায় রাজধানীর কাফরুলে গলায় দড়ি দিয়ে জাহিদুল ইসলাম জালাল নামে এক আর্জেন্টিনা সমর্থক আত্মহত্যা করে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা বাঙালি, আমরা কখনো হারতে শিখিনি। আমরা আবেগ আর আন্তরিকতা দিয়েই দেশ স্বাধীন করেছি। আর সেই আবেগ দিয়েই বিভিন্ন রাষ্ট্রের ফুটবল দলকে সমর্থন দিচ্ছি। সমর্থন দিতে গিয়ে নিজের দেশের চেতনাও ভুলে যাই। আসুন আমরা আমরা আবেগতাড়িত হয়ে নিজের দেশের চেতনা সমুন্নত রাখি, হানাহানি, মারামারি এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকি।

শফিকুল ইসলাম খোকন
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/২৭ জুন

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)