কোথায় চলেছে মনুষ্যত্ব

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১১:১৭ এএম, ৩০ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ০৬:৫১ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

কোথায় চলেছে মনুষ্যত্ব
শফিকুল ইসলাম খোকন
সবচেয়ে মধুর শব্দ। সর্বোত্তম শ্রুতিমধুর এক অক্ষরের একটি শব্দ। যে শব্দের সঙ্গে অন্য কোনো শব্দের তুলনা হয় না। যিনি সহজাত মমত্ব দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন সব সময়, তিনিই ‘মা’। তাই সবাই বলে, মায়ের মতো আপন কেউ হতে পারে না। একজন শিশু কেন? সব সন্তান মায়ের কাছেই সবচেয়ে নিরাপদ। মমতাময়ী মায়ের সঙ্গে মনুষ্যত্বের একটি বিশাল মিল; যা একে অপরের পরিপুরক। যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো পরিবেশে কে আপনাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারবে? উত্তরটা অনেক সোজা। মা ছাড়া আর কেউ সময়, অবস্থা ও পরিবেশ বিবেচনা না করে ভালোবাসবে না।

মাকে নিয়ে ভালো কিছু লিখতে সবসময়ই ভালো লাগে। ভালো লাগবে না কেন? মা যে মমতাময়ী। মায়ের মাধ্যমে যে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখেছি। মাকে নিয়ে (খারাপ বলব না) ভালো না লাগার বিষয় লিখতে কষ্ট হয়। মাকে খারাপ ভাবা তো দূরের কথা, খারাপ কিছু লেখাও কষ্টকর। কিন্ত সম্প্রতি গণমাধ্যমে মাকে নিয়ে কিছু সংবাদ দেখা যায়, তাই মাকে নিয়ে নতুন করে

ভাবতে হচ্ছে। যে মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ

মনে করা হয়, সেই মা তার শিশুসন্তানকে হত্যা করছেন এটি ভাববার বিষয় এবং এটাই স্বাভাবিক। ভাবনা না হওয়াটাই এ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ।

একটি জাতির যখন নৈতিক অধঃপতন ঘটে, তখন সেই জাতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। মা যদি অনিরাপদ হয়, তাহলে সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় এবং একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্র তখন শত চেষ্টা করেও সমাজের

স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে না। মুনষ্যত্ব এমন

পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, ‘মা’ শব্দটি নিয়ে প্রশ্ন

উঠছে। আগে দেখা গেছে সন্তানের হাতে মা খনু হয়েছে। মায়ের হাতে সন্তান খুনের কাহিনি খুব একটা শোনা যায়নি।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মায়ের হাতে সন্তান হত্যা হচ্ছে এবং তা প্রায়ই। স¦ভাবতই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, আমাদের মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতা কোথায় ঠেকেছে? আসলে কি লোপ পাচ্ছে সব নান্দনিক উপসর্গ?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এমনটাই বলছে। আগে দেখা যেত, জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সন্তানের হাতে বাবা-মা খুন, নেশার টাকা দিতে না পারায় বাবাকে হত্যা ইত্যাদি। কিন্তু আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, হয়তো এর আগে কখনো শুনিনি বা দেখিওনি অবুঝ শিশুকে সন্তানকে মা অথবা বাবা হত্যা করেছে। কখনো কখনো মা-বাবা সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছে। এমন ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি। চলতি মাসের ১৯ তারিখে নিজের গর্ভজাত তিন দিনের ছেলেকে পাঁচ তলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করে মা সীমা আক্তার (২৫)। নিজ হাতে হাসপাতালের পাঁচ তলার ছাদ থেকে ছেলেকে ফেলে হত্যার পর নিজেও গড়িয়ে পড়ে জীবন দেন সীমা। ২২ অক্টোবর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় প্রতিবন্ধী মেয়ে তমালিকাকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর মা শান্তি রাণী মন্ডলও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। চলতি বছরের ১ সেপ্টে¤¦র পুলিশের ভাষ্য মতে, হবিগঞ্জের মাধবপুরে দুই সন্তানকে জবাই করে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছে। শিশু দুটির লাশ গলাকাটা অবস্থায় ঘরের খাট ও মেঝেতে পড়েছিল। আর মায়ের লাশটি পাশেই ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছিল। সম্প্রতি গাজীপুরের রেল লাইনে বাবা ও মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনাও দেখতে হয়েছে। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা তালতলা এলাকায় পারিবারিক দ্বন্দ্বে প্রতিবন্ধী পাঁচ বছরের শিশু পুত্র রিয়াদকে জবাই করে হত্যার পর পিতা হাবিবুর রহমান গলায় ছুরি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এ তো গেল দেশের কয়েকটি ঘটনা। এমন ঘটনা যে শুধু দেশে হয়েছে তা নয়, বিদেশেও অহরহ ঘটছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাবা-মার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ ভাইবোন। দেশটির পুলিশ ওই ১৩ ভাইবোনকে উদ্ধার করেছে। দুই থেকে ২৯ বছরের ছেলেমেয়েদের তাদের বিছানার সঙ্গে শিকল দিয়েবেঁধে রেখেছিল তাদেরই বাবা ও মা। ২০১৫ সালের মে মাসে গর্ভধারিনণী মা তার ১৩ মাসের শিশু সন্তানকে ধারালো কাঁচি দিয়ে জবাই করে হত্যা করেছে। কী এমন দোষ ছিল সীমার তিন দিনের পুত্র সন্তানের। যে অবুঝ সন্তান পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার আগেই মায়ের প্রতিহিংসার বলি হতে হলো? ওরা কাকে দোষ দেবে, ওদেরই বা কী দোষ ছিল? বাবা-মায়ের পারিবারিক কলহ, অভাব ও অনটন আর পরকিয়ার বলি এসব সন্তানদের এ রকমের পরিণতির বিচার কী হবে?

এখন প্রশ্ন আসতে পারে বা আসাটাই স্বাভাবিক। একটি সন্তান মায়ের গর্ভে আশা থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে মা সন্তানকে বিপদে-আপদে আগলে রাখেন সে মা কীভাবে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে।

এ প্রশ্ন আমারও; তবে আমার ক্ষুদ্র মেধায় যেটি বুঝতে পারছি সেটি হলো, মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা বা মস্তিষ্ক যখন বিকৃত, তখনই এ রকমের ঘটনা ঘটানো সম্ভব। মনুষ্যত্বের অধঃপতনের আরো নৃশংস চিত্র দেখা যায়, বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষণের চিত্রে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলে ও নাটোরে, ২০১৬ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে ও সিলেটে বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া এমন ঘটনা আরো ঘটছে, যা হয়তো পত্রিকার পাতায় উঠে আসছে না।

প্রতিটি শিশুই আল্লাহর দান। ফুলের মতো নির্মল, নিষ্পাপ। নির্মোহ ও নিরপরাধ। ফুল ও শিশুকে যারা ভালোবাসে না তারা অমানুষ অথবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নিজের শিশুসন্তান তো বটেই, অন্যের এমনকি জীবনের দুশমন হলেও তার শিশুসন্তানের প্রতি কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে না, যার সামান্যতম মানবতাবোধ থাকে। মানুষ তো বটে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশুপাখিও নিজের সন্তানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। মায়া, মমতা, সহানুভূতি এসব গুণ মহান আল্লাহ্ই দিয়েছেন তার বান্দাদের। তবে নানা কারণে প্রকৃতিতে যেমন বিপর্যয় দেখা দেয়, তেমনই মানুষের চিন্তা-চেতনাতেও বৈকল্য ঘটে। বিপর্যয় দেখা দেয়। বিশেষত, মানসিকভাবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জীবন সম্পর্কে হতাশা, উপার্জনহীনতা, আপনজনের সঙ্গে বিরোধ, সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকলে অনেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেকে সামলাতে পারে না। তখন অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপনজন, স্ত্রী-পরিজন,

এমনকি প্রিয় সন্তানকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না এমনই

নিষ্ঠুর ও নির্মম কর্মকা- আমাদের সমাজে ঘটছে প্রায়ই। মায়ের হাতে সন্তান? এটাও কি সম্ভব! এমন নিষ্ঠুরতাও এখন

সমাজে ঘটছে। কিন্তু কেন? এর উত্তর কি কারো কাছে আছে? এখনই সময় এসেছে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। এ রকমের অপরাধের সংখ্যা এখন কম। এ বিষয়গুলোও সরকারসহ সবার মাথায় রাখতে হবে। মা তার সন্তান গর্ভে থাকাকালীন নিজের রক্ত এবং পৃথিবীতে আসার পর বুকের দুধ নিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষা করে। তারপর সন্তান যখন বড় হতে থাকে, তখন সারাক্ষণ তাকে সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখে মা। আর যেকোনো বিপদ মোকাবিলা করার মোটিভেশন আমরা মায়ের কাছ থেকেই পাই। মা এমন একজন মানুষ, যিনি সন্তানের ভালোর জন্য পৃথিবীর সব বাধা ভাঙতে রাজি থাকেন সব সময়। নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানকে ভালোবাসেন। মায়েরা ক্লান্ত হয়, ব্যথা পায়, কিন্তু সন্তানের জন্য সবকিছু ভুলে থাকে। একটি জাতির যখন নৈতিক অধঃপতন ঘটে, তখন সেই জাতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়, সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় এবং একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্র তখন শত শক্তি থাকলেও কোনো কিছু করার থাকে না। আর যখন মা নামের ব্যক্তিদের নিয়ে

নৈতিকতার প্রশ্ন আসে কী করার আছে। আসুন আমরা এ রকমের মায়ের হাতে যেন কোনো কিছুর মর্মান্তিক মৃত্যু না ঘটে, সে জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। সচেতন করি ব্যক্তি ও পরিবারকে। ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের পাশে দাঁড়াই, অসহায় মায়েদের পাশে দাঁড়াই। বাঁচিয়ে রাখি সুন্দর দেশটিকে।

শফিকুল ইসলাম খোকন
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
msi.khokonp@gmail.com

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)