আজ জাতীয় পতাকা দিবসলাল-সবুজের পতাকার কেন অবমূল্যায়ন?

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১০:১২ পিএম, ৩ মার্চ ২০১৮

---শফিকুল ইসলাম খোকন
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- বাংলাদেশকে ভালোবাস? উত্তরে আসবে ‘হ্যা’ যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- জাতীয় পতাকাকে ভালোবাস? উত্তরে আসবে ‘হ্যা’। ঠিক তেমনি যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- জাতীয় পতাকার আকার, ব্যবহারের নিয়ম জানো? উত্তরে…। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিদার নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব রয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস-ঐতিহ্য জানা, সংরক্ষণ করা তেমনি রয়েছে জাতীয় পতাকাকে সম্মান এবং ব্যবহারের নিয়ম জানা।

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য অস্ত্ম গিয়েছিল, তা একাত্তরের মার্চে পুনরায় উদিত হয়। বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেশকে শত্রম্নমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে শরিক হয়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ধরনের ঐক্য আমাদের জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয় নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে, সে জাতি কোনো দিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন দিন, এক সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘আর আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সুতরাং জাতির অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। জাতির এই লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতির কারণেই তখনকার সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করেন বাঙালি বীর সন্ত্মানরা, এমনকি সুদূর পাকিস্ত্মান থেকেও মৃতু্যকে উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জনগণের অন্ত্মরাত্মার প্রস্তুতি অনুভব করেই পাকিস্ত্মান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার নৈতিক শক্তি তারা পেয়েছেন বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্ত্মানিদের বিরম্নদ্ধে। শুরম্ন হয় স্বাধীনতা, ৯ মাস যুদ্ধ শেষে লাল-সবুজের স্বাধীন রাষ্ট্র পায় বাংলাদেশ।

আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ করিওনি। তবে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আমাকে কাঁদায়। সব সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যে জাতি জীবনের বিনিময় দেশ স্বাধীন করেছে, সে জাতি কখনোই হেরে যাওয়ার নয়; হারতে শেখেনি, হারতে পারেও না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমি শুনেছি। যতবারই শুনি ততবারই দেহের ভেতরে মন নামক প্রাণটি ভাবিয়ে তোলে, বিবেক তাড়িত করে। প্রশ্ন করে- ‘তুমি মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, মুক্তিযুদ্ধ করনি, কিন্তু যা দিয়ে গেছি, তা কি তুমি সংরক্ষণ করছ? সম্মান দিচ্ছ? না কি সব পেয়ে ভুলে গেছ।’ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর বাঙালি জাতির জীবনে সোনালি দিন হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলো। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম আর আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের গৌরবময় দিনগুলো আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা নামক শব্দটি ভুলে যেতে বসেছি? আমরা সেই লাল-সবুজের পতাকাকে সংরক্ষণ করছি, ইতিহাস-ঐতিহ্য কি বুকে আগলে রাখছি। আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে মনে করি- ‘না পারিনি, পারছিও না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব কার? কে সংরক্ষণ করবে। নতুন প্রজন্মকে জানান দেয়ার দায়িত্ব বা কাদের? আর সেই দায়িত্ববোধ থেকে কতটুকুই দায়িত্ব পালন করছি, নতুন প্রজন্মের মাঝে কতটুকু স্বাধীনতা-বিজয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরছি?’

একটি জাতীয় পতাকা একটি জাতি রাষ্ট্রের অভু্যদয়, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি স্বীকৃতি। জাতীয় পতাকা হলো জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এবং শহীদদের সম্মানের প্রতীক। জাতীয় পতাকা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে, বিশ্বের কাছে দেশকে পরিচিত করে। আমরা কি দেখছি, সেই জাতীয় পতাকাকে আমরা মূল্যায়নের চেয়ে অবমূল্যায়নই বেশি করছি। তার কারণ হতে পারে দু’রকমের একটি হলো পাতাকার নিয়ম-কানুন না জেনে বা যেনেও না জানার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া। আমরা দেখছি, কখনো কখনো আবেগের বসে জাতীয় পতাকা ঠেলাগাড়ির রডের সঙ্গে বেঁধে রাখা, ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ম না মেনে পাতাকা টানানো, পাতার সঙ্গে নির্ধারিত বাঁশ বা অন্য কিছু ব্যবহার না করে অবেহলার মতো কোনো রকম ভাঙা বাঁশ, লাঠি, ভাঙা পস্নাস্টিকের পাইপ দিয়ে পতাকা টানানো হচ্ছে। এ বিষয় কঠোর হস্ত্মক্ষেপ না থাকা এবং আইন জানার কারণেই এ রকমটা হচ্ছে।

তবে আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ বলা আছে, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। এবং লালবৃত্তটি ঠিক কোন অংশে থাকবে, সেটিও উলেস্নখ করা আছে। আইনে পতাকার রঙ, ছোট গাড়ি, মাঝারি বা বড় গাড়িতে এর আয়তন সবই লেখার পাশাপাশি পতাকা উত্তোলনের বিষয়েও বলা আছে। ইচ্ছে করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন না। বিধিমালার ‘৪ এর (১) নিম্নবর্ণিত দিবস এবং উপলক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনসু্যলার পোস্টসমূহে নিম্নরূপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করিতে হইবে: (ক) মহানবীর জন্ম দিবস (ঈদে মিলাদুন্নবী); (খ) ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস; (গ) ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস; (ঘ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোনো দিবস।

১ (২) নিম্নবর্ণিত দিবসসমূহে ‘পতাকা’ অর্ধনমিত থাকিবে: (ক) ২১ ফেব্রম্নয়ারি শহীদ দিবস; (খ) ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস; এবং (গ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোনো দিবস।’ কিন্তু বাস্ত্মবে দেখা গেছে, অনেকই জায়গায়ই অসচেতনার কারণে অনেক ব্যতিক্রম ঘটে। তবে এটি সত্য যে, জাতীয় পতাকা ব্যবহার রয়েছে সর্বোচ্চ প্রশংসনীয় পর্যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনিটরিং, নিয়ম ও বিধি মানা হচ্ছে না মানতে দেখা যাচ্ছে না।

আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে ওই ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত্ম শাস্ত্মি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়। না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্ত্মির বিধান যথাযথ হতে পারে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাণিজ্যিক কোনো প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধিবহির্ভূতভাবে করে থাকে, তার জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে, যাকে অনেকেই অপ্রতুল মনে করছেন। আইনে এত বিধি বিধান থাকলেও বাস্ত্মবে এর রূপ দেখা যায়নি। দেখা যায়নি তেমন কোনো শাস্ত্মি দিতে। আমরা মনে করি- জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নিয়মের বিষয় জনগণকে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সভা-সেমিনার করা উচিত। আইনটি সবার জানা দরকার এবং পতাকা আইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং দরকার। ইউনিয়ন-ওয়ার্ডভিত্তিক নির্ধারিত একটি দিনে শুধু পতাকা নিয়ম-আইনসহ নানা বিষয়ে সচেতন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে শুধু সরকার বা প্রশাসন নয় জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে একদিন স্বাধীন-সার্বভৌমের ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যেতে বাধ্য।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্ত্মিত্বকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার, একইভাবে জাতীয় পতাকার সম্মানও অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় পতাকার মান অক্ষুণ্ন্ন রাখব স্বাধীনতার মাসে এটাই প্রত্যাশা করছি।

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/২ মার্চ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)