একাত্তরের ৭ মার্চ : ঐতিহাসিক ও উজ্জ্বলতম দিন

এ এস এম জসিম
এ এস এম জসিম, বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৮:৩০ এএম, ৭ মার্চ ২০১৮

ফাইল ছবিশফিকুল ইসলাম খোকন
একাত্তরের সাত মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী জনতার সামনে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যা আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনীয়।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এটি একটি মহাকাব্যিক রাজনৈতিক ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপম-ূকতা থেকে মুক্ত করার দিক-নির্দেশনা ছিল এই ভাষণে। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রত্যাশাকেই মূর্ত করেছেন ৭ মার্চের ভাষণে। তার বজ্রকণ্ঠের আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আনাচে-কানাচে আকাশে-বাতাসে।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই’। তিনি আরও বলেন, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্ত্মান্ত্মর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারব কি পারব না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু উদাত্তকণ্ঠে বলেন- ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করো…’। ‘প্রত্যেক মহলস্নায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআলস্নাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে এগিয়ে আসতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি সরকারবিরোধী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর আপামর জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে দেশ।

অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ‘বিশ্বঐতিহ্য’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষণ নিয়ে গবেষণা চলছে।  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় এই ভাষণ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলেও এর ঐতিহাসিক পটভূমি ছিল দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্ত্মান নামে দুটি দেশ জন্ম নেয়। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হিন্দু, পাকিস্ত্মানে প্রাধান্য ছিল মুসলমানদের। পাকিস্ত্মানের ছিল দুটি অংশ- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্ত্মান। পূর্ব পাকিস্ত্মান ও পশ্চিম পাকিস্ত্মানের মধ্যকার দূরত্ব ছিল হাজার মাইলেরও বেশি। সংস্কৃতিগতভাবে পূর্ব পাকিস্ত্মান তথা পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্ত্মান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

পাকিস্ত্মান রাষ্ট্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্ত্মানি সামন্ত্ম ও সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে। পাকিস্ত্মান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই দেশ শাসন ও অর্থনৈতিক নীতিতে উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্য দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্ত্মান থেকে কৃষিপণ্য ও অন্যান্য সম্পদ পশ্চিম পাকিস্ত্মানে পাচার হতে থাকে। এর পর শুরম্ন হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরম্ন করে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই মহান স্বাধীনতা।

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের প্রদত্ত ভাষণ নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্ত্মর্ভুক্তির। একই সঙ্গে জনসমক্ষে এই ভাষণ বেশি বেশি বাজানো, প্রচার করা। একটি কথা চির সত্য যে, শুধু বাংলাদেশ, বাঙালি নয়, বিশ্বের মুক্তিকামী, অধিকার বঞ্চিত, স্বাধীনতাকামী জনগণের জন্য এই ভাষণ, অনুপ্রেরণা এবং দিকনির্দেশনা জোগাবেন। তাই দেশের, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর এই ভাষণ একই সূত্রে গাথা।
লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com

পাথরঘাটা নিউজ/এএসএমজে/৭ মার্চ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)